বাংলাদেশের ইতিহাসের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ জরিপ ও নির্বাচন নিয়ে বলবো।
১৮৭২ সালের প্রথম যে বেঙ্গল জরিপ টা হয় তাতে জানা যায় যে বেঙ্গল ডেলটা তে মুসলমানের সংখ্যা হিন্দুর থেকে বেশি, স্পেশালি ইস্টার্ন বেঙ্গলে এইটা সিগনিফিক্যান্টলি বেশি। এই সত্যটা সে সময় অনেকেই জানতো কিন্তু যেহেতু এর আগে কোন জরিপ হয় নাই তাই এটা কোয়ান্টেটিভ্লি প্রুভেন ছিলোনা। আপনি দীপেশ চ্যাটার্জির বইয়ে দেখবেন দীপেশ এদেরকে বলতেছে “সাইলেন্ট মেজরিটি” কারণ এদের সংখ্যা যদিও বেশি কিন্তু এদের রিপ্রেজেন্টেশন ছিল না তৎকালীন সুশীল সমাজে। কলকাতায় যে সুশীল সমাজ গড়ে উঠেছিল বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকদের সেইটা মূলত উত্তর কলকাতার ১০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটা কোকুন, অন্ত্যজ মুসলমানদের ভয়েস সেইখানে ছিলোনা। এই মেজরিটি আন্ডারভয়েসড মুসলমানেরা সাতচল্লিশে নিজেদের একটা দেশ কায়েম করেছিলো।
পূর্ব বাংলার মানুষ প্রথম যে বছর ভোট দিতে পারে সেটা হচ্ছে ১৯৭০ সাল। এর আগে কিন্তু ইউনিভার্সাল এডাল্ট ফ্রাঞ্চাইজি ছিলোনা মানে প্রত্যেকের একটা করে ভোট এবং প্রত্যেকে ভোট দিতে পারবে এ ব্যাপারটা চুয়ান্ন বা বাষট্টিতে ও ছিলোনা। সেই ইলেকশনের আগে পাকিস্তান মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের অনুমানে পূর্ব বাংলায় আওয়ামীলীগকে ঠেকানোর জন্য পিডিপি, নেজামে ইসলামী ও জামাতে ইসলামি যথেস্ট ছিলো। এই এশিউরেন্সেই তারা ইলেকশনে গেছিলো। সমস্ত হিসাব নিকাশ পালটে যায় যখন আওয়ামী লীগ একটা ল্যান্ড স্লাইড বিজয় পায় এবং মোট ভোটের ৭৪.৯ ভাগ তাদের পক্ষে যায়। প্রতি চারজন পূর্বপাকিস্তানীর তিনজন আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। এইটা একটা আনবিলিভেবল নাম্বার। নেহেরু স্বাধীন ভারতের প্রথম ইলেকশনে ১৯৫১ সালে চুয়াল্লিশ ভাগ পপুলার ভোট পাইছিলেন। মোট ভোটের পঁচাত্তর ভাগ পাওয়া যেকোন দেশে যেকোন সময়ে যেকোন নেতার জন্য একটা আনপ্যারালাল ঘটনা।
বাকিটা ইতিহাস।
তৃতীয় ঘটনা ঘটে একানব্বইয়ে। এরশাদ পতনের পরে সেই ইলেকশনে হট ফেভারিট ছিল আওয়ামী লীগ কারণ তাদের সাংগঠনিক শক্তি অনেক বেশি ছিল বিএনপির থেকে। বিএনপিকে বলা হইতো সামরিক ছাউনিতে জন্ম নেওয়া দল আর আওয়ামীলীগ হচ্ছে গণমানুষের দল। তখন কেউ কল্পনাও করতে পারে নাই যে বিএনপি গভমেন্ট ফর্ম করবে এবং শোনা যায় শেখ হাসিনা অলরেডি কেবিনেট ঠিক করে ফেলছিলেন কিন্তু ইলেকশনের রেজাল্ট যখন বের হয় তখন দেখা গেল বিএনপি পাইছে ১৪০টা সিট আর আওয়ামীলিগ পাইছে ৮৮টা সিট। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার আপোষহীনতার এফেক্টিভ ব্র্যান্ডিংকে এই ঘটনার নিয়ামক ধরা হয়।
কাট টু ২০২৬ ফেব্রুয়ারী।
এইখানে চারটা ঘটনা ঘটতেছে।
প্রথমত এই ইলেকশনে আওয়ামীলিগ নাই কিন্তু তার ভোটব্যাঙ্ক রয়ে গেছে। ২০০৮ এ তারা জোট করে আটচল্লিশ ভাগ ভোট পাইছিলো। আমার হিসেবে এর কমপক্ষে বেয়াল্লিশ ভাগ কোর আওয়ামী ভোটার। যেহেতু চল্লিশ ভাগ নতুন ভোটার এবং এরা আওয়ামী আমলে বড় হইছে আমি ধরে নিচ্ছি এদের মাঝে খুবই ইনসিগ্নিফ্যান্ট অংশ আওয়ামীলীগ করবে। সো, ডাইলিউট হয়ে টোটাল ভোটারের এরাউন্ড ২২ থেকে ২৫ ভাগ থাকবে যারা সবকিছুর পরেও নৌকায় ভোট দিবে। নৌকা যেহেতু নাই আমি চেস্টা করবো এরা যেন আমাকে ভোট দেয়, অথবা ভোটই দেয়না। আমার জন্য সবচেয়ে আনফেভারেবল আউটকাম হবে যদি এরা আমার প্রতিপক্ষকে ভোট দেয়। উদাহরণ হিসেবে আমেরিকান ইলেকশন দেখতে পারেন। ট্রাম্প হিলারিকে হারাইতে পারছিলো কারণ অনেক ডেমোক্র্যাট ভোটার হিলারিকে ট্রাম্প থেকে বেশী অপছন্দ করতো এবং ভোট দিতে যায়নাই। বাইডেনের সময়ে তারা ট্রাম্পকে ঠেকাইতে ভোট দিছিলো এবং বাইডেন জিতছিলো। ভোটার মোবিলাইযেশনকে ম্যানুভার করতে পারা ইলেক্টোরাল ডেমোক্র্যাসিতে গুরুত্তপূর্ণ।
দ্বিতীয় পয়েন্ট হচ্ছে চল্লিশ ভাগ নতুন ভোটার। এরা জীবনে ভোট দেয়নাই এবং এটা হাইলি লাইকলি যে তারা অন্য এইজ গ্রুপের চেয়ে ভোটের ব্যাপারে বেশী আগ্রহী থাকবে। ভোটকেন্দ্রে টোটাল টার্নআউটের হিসাবে এদের ইম্প্যাক্ট চল্লিশ ভাগের থেকে বেশী হবে, ধরে নেই বেয়াল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশ ভাগ। আমি এদেরকে একটা ব্লক ভাবতেছি কিন্তু এরা পলিটিক্যালি ও ইকোনমিক্যালি ডাইভার্স একটা গ্রুপ। আমার যদি একটা সুতা দরকার হয় এদেরকে বাধার জন্য, সেটা হবে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, চাকরি ও ব্যাবসার সুযোগ। আমরা কেউ এদের পলিটিক্যাল ওরিয়েন্টেশন জানিনা, এরা আমাদের ডাটাসেটের বাইরে কিন্তু আমরা জানি এরা ইকোনমিক্যালি প্রিকারিয়াস। এরা উপার্জন করতে চায়, ডিগনিটি চায় এবং প্রবল হাসিনা রেজিমে বড় হওয়া তরূণ বিধায় এন্টি ইন্ডিয়ান।
তৃতীয় পয়েন্ট হচ্ছে প্রবাসী ভোটার। মোটামুটি আশি লাখ থেকে এক কোটির কাছাকাছি লোক প্রবাসে থাকে এবং এর সিংহভাগ থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। ধারণা করা হচ্ছে এরা এই প্রথমবারের মত ভোট দিতে পারবে কিন্ত যেহেতু লজিস্টিক্সের সমস্যা থাকবে এবং বেশীরভাগই মজদুর সুতরাং ভোটার টার্নআউট পঞ্চাশ ভাগ হওয়াটাই অনেক। এই ভোটগুলো সবচেয়ে ইজি উইন কারণ আপনি জাস্ট দূতাবাসের কিছু রিফর্ম ঘোষনা করেই এদের কাছে টানতে পারবেন। আওয়ামী লিগ বিএনপির কিছু কমিটি আছে এইসব দেশে কিন্তু এরা যেহেতু কখনোই ভোটের হিসাবে ছিলোনা তাই এদের কন্সার্নগুলো কখনো মেইন্সট্রিমে আসেনাই। আপনি জাস্ট প্রব্লেমগুলো এড্রেস করেই এই ভোট টানতে পারবেন।
চতুর্থ ও সবচেয়ে গুরুত্তপূর্ন পয়েন্ট হলো এইবার প্রথমবারের মত আমরা উচ্চকক্ষ পাবো যেখানে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি আসবে, অর্থাৎ ভোট নস্ট না করার জন্য আগে যেভাবে মানুষ সম্ভাব্য জয়ী প্রার্থীকে ভোট দিতো, সেটা আর ঘটবেনা। এভ্রি ভোট কাউন্টস। এই ঘটনা আমাদের ইলেক্টোরাল আন্ডারস্ট্যান্ডিঙ্গের ইতিহাসে একটা বড় জাম্প। আপনি জাস্ট একানব্বইয়ের ইলেকশন চিন্তা করেন। বিএনপি মাত্র দশমিক ৭৩ ভাগ ভোট বেশী পাইছিলো আওয়ামীলীগ থেকে, ইভেন এক শতাংশ ও না, কিন্তু সিট বেশী পাইছিলো বায়ান্নোটা। পপুলার ভোট আড়াই লাখ বেশী পেয়ে তারা সিট বেশী পাইছে বায়ান্নোটা। লোয়ার হাউজে এই নিয়মই থাকতেছে কিন্তু আপার হাউজে যেহেতু টোটাল ভোট কাউনট হবে, আমি নতুন দল হইলে আমি আমার স্ট্র্যাটেজি এমনভাবে সাজাবো যেন ম্যাক্রো লেভেলে আমি সর্বাধিক সংখ্যক ভোটারকে রিচ করতে পারি। লোয়ার হাউজে আমি মাইক্রো ম্যানেজমেন্টে যাবো কিন্তু আমার ইলেক্টোরাল স্ট্র্যাটেজি এই কম্পোজিশন মাথায় রেখে করবো আমি।
রিসেন্ট যে জরিপগুলো হইছে বাংলাদেশে আমি এগুলার ক্রেডেবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতেছিনা। বাংলাদেশে আপনি একটা সিটে আটত্রিশ থেকে চল্লিশ ভাগ ভোট পাইলেই জিততে পারবেন যেহেতু বিরোধীদের ভোট ভাগ হয়ে যাবে। আওয়ামীবিহীন বাংলাদেশে যেকোন সিটে এই পরিমাণ ভোট আদায় করার মতন সাংগঠনিক ক্ষমতা শুধুমাত্র বিএনপি এবং কিছু ক্ষেত্রে জামায়াতের আছে। সুতরাং আটত্রিশ ভাগ ভোট নিয়ে লোয়ার হাউজে সত্তর ভাগ সিট বিএনপি নিয়ে নিতে পারবে, এইটাই সবচেয়ে সম্ভাব্য আউটকাম। এই ইকোয়েশনকে ডিস্টার্ব করার জন্য যে সাংগঠনিক সক্ষমতা দরকার তার জন্য নতুনদের কমপক্ষে দুইটা ইলেকশন সাইকেল লাগবে বলে আমার অনুমান।
ইন্ডিয়ায় একজন ভদ্রলোক আছেন, প্রশান্ত কুমার, পিকে। মোদীর গুজরাট রিইলেকশন, ২০১৪ সাধারণ নির্বাচনের বিজয়ের মাস্টারমাইন্ড এই ভদ্রলোক। মমতার গত বিধানসভা বিজয়ের পিছনে ও এই বিহারী ভদ্রলোকের অবদান আছে। পাঞ্জাব, ইউপি, অন্ধ্রপ্রদেশে বেশকিছু মোদীবিরোধী জয়ী ক্যাম্পেইনের স্ট্র্যাটেজিস্ট এই ভদ্রলোক। Citizens for Electoral Governance নামে উনার একটা সংগঠন আছে। কোনধরণের কোন সন্দেহ ছাড়া বলা যায়, উনি দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে সফল পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিস্ট। একটা ইন্টারভিউতে পিকে বলছিলেন, বেকার তরুণেরা যখন ভোট দিতে যায় তখন তারা হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে যায়না, বেকার হিসেবে যায়।
বাংলাদেশে এই নতুন বাস্তবতায় যারা ইলেকশন স্ট্র্যাটেজি সাজাবেন, তারা এই কথাটা মাথায় রাখলে সুফল পাবেন।