সম্মিলিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমন্বয়কের সাক্ষাৎকার
মো: তানিম ওয়াহিদ, ইউনিভার্সিটি অফ স্কলার্স
সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড থেকে প্রকাশিত শিবলী আজাদ ও মিনহাজুল ইসলামের সম্পাদনায় "পনেরো সমন্বয়কের সাক্ষাৎকারঃ জুলাই অভ্যুত্থান ও সম্মিলিত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়"। ইউনিভার্সিটি অফ স্কলার্স একজন সাধারণ ছাত্র মো: তানিম ওয়াহিদ জুলাই অভুত্থানে সমন্বয়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অরাজনৈতিক বলে পরিচিত এই প্রজন্মের মাঝে রাজনৈতিক চেতনার বীজ কীভাবে অঙ্কুরিত হলো? আতঙ্কের সেই দিনগুলোতে তারা কীভাবে ঐক্য ধরে রেখেছেন? তাদের অতীত কী? এসব নিয়েই নীচের সাক্ষাৎকারটি।
প্রশ্নঃ ছাত্র রাজনীতি বা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশ নেয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড কি আপনার আছে? কোন ছাত্র সংগঠন বা কোনধরনের সংগঠনের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আপনি কি জড়িত বা আগে জড়িত ছিলেন? কিংবা এই আন্দোলনের আগে কোনো রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নেবার কোনো অভিজ্ঞতা আছে কি আপনার?
উত্তরঃ এই আন্দোলনের ঠিক একদিন আগে, অর্থাৎ ১০ই জুলাইয়ের একদিন আগ পর্যন্ত আমি কোনো রাজনৈতিক দল এবং কোনো ছাত্রসংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম না। তবে, আমি কিছু স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলাম, যেগুলো শুধু এলাকা ভিত্তিক কাজ করে। অর্থাৎ, আমি স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলোর সাথে ছোট থেকেই কাজ করি। ছোট থেকে বলতে বুঝাচ্ছি, আমি যখন স্কুলে ছিলাম বা পরবর্তীতে যখন কলেজে উঠি, তখন থেকে যেমন বনানী স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন। আবার আমি যখন উওরায় ছিলাম, সেখানে ছিল বৃহৎ উওরা। রাজনৈতিক সংগঠন বা রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে আমার ইনভল্ভমেন্ট কখনই ছিল না। আমার বুঝ হবার পর আমি হয়তো একটি আন্দোলন করেছিলাম, তা হলো ২০১৮ সালের আন্দোলন। যখন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পরবর্তীতে প্রথম কোটা আন্দোলন হয়, তখন আমি কলেজে পড়ি। সে সময় আমি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। এর পরবর্তীতে ১০ই জুলাই যখন এই আন্দোলন শুরু হয়, তখন সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশগ্রহক হিসেবে আমি অংশগ্রহণ করি।
প্রশ্নঃ আমাদের সমাজে একটি কনভেনশন আছে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকুরী বা কোটা তে তেমন আগ্রহী না, কিন্তু এই বার কোটা আন্দোলনে বিপুল পরিমাণে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল; এই যে বিপুল পরিমাণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেয়ার যে বিষয়, এর কারণ কি ছিল বা তারা কিসের জন্য এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে, আপনার কাছে কি মনে হয়?
উত্তরঃ আমরা যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট মোটিভ ধরি, তারা শুধু কোটা বিরোধী আন্দোলন যেটি শুরু হয়েছিল সেটির জন্যই ম্যাস ভাবে আসে এবং এর ফলাফল আজকের গণঅভ্যুত্থান। তবে এটি আসলে ভুল ধারণা। কারণ, ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলন আমাদের শুরু হয় ১০ তারিখে এবং ১০-১৫ জন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। সেখানে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভল্ভমেন্টটি দেখা যায়নি, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভল্ভমেন্ট দেখা যায় ১৬ তারিখে, যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্যান্য জায়গায় হেলমেট লীগ (ছাত্রলীগ) আন্দোলনকারীদের ওপরে নির্যাতন চালায়। আমি, আমরা দিন শেষে স্টুডেন্ট। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, তারা দিন শেষে আমাদেরই ভাই। আমরা আসলে কোটা বিরোধী আন্দোলন বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনে নামিনি। আমরা আন্দোলনে নেমেছি এই যে ফ্যাসিস্ট প্রথা যে, আন্দোলন করলেই তাদের উপর হামলা করতে হবে, এদের বিরুদ্ধে। ঢাবি, জাবির ছাত্রলীগ সভাপতিদের যে পাষণ্ড নির্যাতন এবং ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল ও বাইরে থেকে লাঠিয়াল বাহিনী এনে যে আক্রমণ করা, আমরা মূলত এর প্রতিবাদে আন্দোলনে নামি। আমরা যখন ১৮ তারিখে আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে নামি, তখন ছাত্রলীগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপরেও পাষণ্ড নির্যাতন চালিয়েছিল।
প্রশ্নঃ ব্যক্তিগতভাবে আপনি কখন বা কবে এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন? আন্দোলনটি আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয় বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানারে যখন শুরু হয় তখন আপনার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলনে কোনো বাঁধা বা কোনো চ্যালেঞ্জে ছিল কি না? কোনো চ্যালেঞ্জে থাকলে সেগুলো কীভাবে অতিক্রম করলেন, কিংবা কোনো ভাবে সাপোর্ট দিয়েছিল? সাপোর্ট দিয়ে থাকলে তা কোন ধরনের ছিল?
উত্তরঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে আন্দোলনের সাথে যুক্ত হই ১০ তারিখ, অর্থাৎ ১০ই জুলাই থেকে। তখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যানার ছিল না, কারণ তখন কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যানার বের করতে পারেনি। সেই এক্সসেপটেন্সি ছিল না, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রমোটও ছিল না, কারণ তখনও এই সরকার ক্ষমতায় ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক প্রেসার আসত এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একদম সি ক্যাটাগরি বিশ্ববিদ্যালয়, খুবই নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয়। সেক্ষেত্রে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যানার বের করার মতো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে পারমিশন বা কোনো কিছুই ছিল না এবং প্রচুর প্রেসার ছিল। ১০ তারিখ থেকে আমি যখন আন্দোলন শুরু করি। আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ম্যাসাকার সিচুয়েশন দেখি। ঘটনাচক্রে, সেই দিন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলাম। আনুমানিক রাত ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে সেদিন আমি কোন মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চিপা দিয়ে বের হয়ে আসি। সেদিন রাতেই আমি একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলি, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাইকে অ্যাড করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে সেই মুহূর্তে সকল ভিডিওগুলো ভাইরাল হয়।
আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা যদি বলি, সকলে আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। বনানীতে টোটাল চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটি খোলার পর সবাই আমার সাথে যোগাযোগ করে, আমাদের সাথে তারা একাত্মতা প্রকাশ করে। আমাদের সব থেকে বেশি অনুশোচনার জায়গা হচ্ছে, আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই তখন ব্যানার ব্যবহার করতে দেয়নি। আমরা সকল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৬ তারিখে একসাথে হই। তখন আমাদের বলা হয়েছিল যে, আমাদের আইডি কার্ড ব্যবহার করা যাবে না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাগ ব্যবহার করা যাবে না। ২-৩টি বিশ্ববিদ্যালয় পারমিশন দিলেও, আমি আমার বিশ্ববিদ্যলায়ের কথা বলবো যে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ব্যাগ জমা দেয়ার পর সকলের রেস্পন্সিবিলিটি আমার উপর দেয়া হয়। ফ্যাকাল্টি মেম্বারা একসময় বলেন যে, আপনারা যাবেন না এই আন্দোলনে। এই আন্দোলনে ম্যাসাকার হবে, সবার রেস্পন্সিবিলিটি নিতে পারবেন না। যারা ছিলেন তাদের সাথে এরপর আমাদের অনেক বাগবিতণ্ডা হয়।
পরবর্তীতে, কিছু শিক্ষক ছিলেন যারা খুব সাপোর্টিভ ছিলেন। তাদের সাথে কথা বলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই জমা দিয়ে রাখি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ও আন্ডার প্রেসারে ছিল। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়টি সেই সময়ে সি ক্যাটাগরির। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ জানে না যে, এটি আসলেই সফল হবে। তখন আমরা আন্দোলনটি বনানী, গুলশান এরিয়াতে করি। গুলশান, বনানী একটি কমার্শিয়াল এরিয়া এবং আমরা এটি ব্লক করে দেই। সে সময় চারটি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে আমরা অল্প কিছু, আনুমানিক ২০০-৪০০ শিক্ষার্থী ছিলাম, আমাদের জন্য সেটা খুব চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমাদের পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পালিয়েছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনতলা পর্যন্ত উঠে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ মেরেছে। তিন তলার মধ্যে আমাদের আটকে মেরেছিল। সেখানের পরিস্থিতি এমন ছিল যে, ২০০ স্টুডেন্টস ভার্সেস ১০০ ছাত্রলীগ।
প্রশ্নঃ একজন সমন্বয়ক বা লিডার হিসেবে আপনার কী কোনো বিশেষ দায়িত্ব ছিল? যদি থাকে তা কেমন দায়িত্ব ছিল বা আপনারা কীভাবে তা পালন করেছিলেন?
উত্তরঃ আমাদের জোনে ছাত্রলীগের সাথে কোয়াড়েল (Note, meaning unlcear?) ছিল। যার ফলে কেউ চাচ্ছিলাম না যে সে ফোকাসে আসুক; ছাত্রলীগ রাতে হামলা চালাক বা ডিবি, র্যাব তাকে ধরে নিয়ে যাক। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাক্সিমাম শিক্ষার্থী চায় নাই যে, তারা কোনো হেনস্তার মধ্যে পড়ুক। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই ছদ্মনাম ব্যবহার করে সমন্বয়ক হিসেবে আসে। তবে, আমি আমার জায়গা থেকে স্ট্রেইটলি আমার নামটি দিয়েছিলাম। এর পিছনেও একটি কারণ আছে। সমন্বয়ক মানে সমন্বয় করা। আমার যে এক্সট্রা কাজটি করতে হতো সেটি সমন্বয় করা। তখন আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো ব্যাচ, ডিপার্টমেন্ট, এদের সাথে যোগাযোগ করি। আমরা সকলেই জানি, বর্তমান সময় প্রতিটি ব্যাচের একটি করে মেসেঞ্জার গ্রুপ থাকে। সেখানে আমি বলি, যারা স্বতস্ফূর্তভাবে আসতে চায়, আসুক। আমি সামনে থাকবো সমস্যা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেডারেশনের দায়িত্ব আমি নিবো এবং আমার উপর সকল দায়ভার চাপিয়ে দিয়েন, আপনারা জাস্ট আসেন। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বনানীতে যেই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়, সেই সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের রেস্পন্সিবিলিটি নিয়েছিলাম।
যদি বনানী সোসাইটি থেকেও কোনো ঝামেলা হয়, তাহলে এটি আমার ওপরে আসুক। আপনারা এর প্রেসার নেবেন না বা ডিএমসি (Note, explain acronym) থেকে কোনো প্রব্লেম হলে সেটি আমার উপরে আসুক। স্পেসিফিক্যালী, দায়িত্ব বলতে গেলে এটি আমার এক্সট্রা ছিল যে, সকল দায়ভার আমার উপর নিয়েছিলাম। যদি কিছু হয়, তা যেন আমার উপর দিয়ে হয়, আপনারা আমাদের সাথে সমন্বয় করুন। আমার যেই এক্সপেক্টেশনস ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি আমাদের পাশের আরও ৩-৪টি বিশ্ববিদ্যালয় সবাই একসাথে হয়।
প্ল্যানিং করার জন্য আমাদের যেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ছিল, সেখানে আমি সব ইনফরমেশন দিতাম। কিন্তু যখন আমি মাঝে মাঝে আমার লোকেশন বলতাম যে আমি এই জায়গায় আছি, তখন আমার উপর পরপর দুই বার অ্যাটাক হয়। যার ফলে আমি এগুলোকে একটি চেইন অফ কমান্ডে নিয়ে আসি। আমার বিশ্বস্ত অর্থাৎ আমি যেই জোনটি নিয়ে কাজ করছিলাম, সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন একজন করে আমি দায়িত্ব দিয়ে দেই যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দেখবে। প্রত্যেকের বিশ্ববিদ্যালয়ের যতগুলো ডিপার্টমেন্ট আছে, প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে সেক্টর ভাগ করে দিয়েছিলাম। তারপর, এই সেক্টর বা কোন ডিপার্টমেন্টে কে কে আছে বা কোন কোন শাখায় কে কে আছে ঠিক করি। কোন কোন সেকশন ঠিক করে, সেই সেকশনের দায়িত্ব একজনের ওপর দিয়েছিলাম যেন এই সেকশনের যারা আন্দোলন করতে চায়, তারা এইভাবে আসবে বা এখানে আসবে। আমি শুধু জুমে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি বা সবগুলো ডিপার্টমেন্ট প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলতাম। কথা বলে তাদের এভাবে সমন্বয় করতাম যে, তাদের সেকশনের যে কয়েকজন সক্রিয়ভাবে আসতে চায়, তারা যেন এখানে থাকে। সিকিউরিটি পারপাসে জিনিসটি আমি অনেকটা চেইন অব কম্যান্ড বা জালের মতো করে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম।
প্রশ্নঃ এ আন্দোলনটি সরকার বিরোধী আন্দোলনে কখন রূপ নিল বা ঠিক কোন জায়গা থেকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তর হয়েছিল আপনার মনে হয়?
উত্তরঃ আমি মনে করি, এটি সরকার বিরোধী আন্দোলনের রূপ নেয় ১৮ তারিখের পর। আমরা দেখেছি যে ১৮ তারিখের পর বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশাল আকারের ক্ষয়ক্ষতি হয়। ছাত্র, সাধারণ জনগণ, রিকশাওয়ালা, পথশিশু, সব ধরণের শ্রেণী ও পেশার এত মানুষ একদিনে মারা গেল। আর সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত ছিলেন দেশের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে। দেশের ক্ষতিগ্রস্ত জিনিসগুলো নিয়ে উনি বেশি ব্যাথিত ছিলেন। সাধারণ মানুষ, নিষ্পাপ বাচ্চা, ও পথশিশু মারা গেলেও বিবেকবোধ থেকে উনি রেস্পন্সিবিলিটি নেবেন, এ বিষয়ে ক্লিয়ার কোন স্টেটমেন্ট ওনার ছিল না। বাংলাদেশের আপামর সাধারণ জনগণ, সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর আওয়ামী লীগের জুজুর ভয় তখন চলে যায়। আমরা জানি, ভয় না থাকলে জয় করা সম্ভব। জুজুর ভয়টি যখন চলে যায়, তখন আমরা বুঝি যে এই সরকারের আয়ু আর বেশি দিন নেই। আমাদের দমানোর জন্য সরকার যখন ব্রডকাস্টগুলো বন্ধ করে দেয়, সরকার তখনই বুঝে, তাদের সময় আসলে খুব কম। আমি মনে করি, এগুলোতে মানুষের অনুপ্রেরণা আরও বেড়ে যায়। মানুষ যখন বুঝতে পারে যে সরকার আমাদের ভয়ে স্টেপ নিচ্ছে, ভয় তখন ধীরে ধীরে জয় হয়। এই ভয়কে আমরা যখন জয় করতে পারি, তখনই ফ্যাসিস্ট সরকার আসলে নিপাত হয়।
প্রশ্নঃ এ আন্দোলনে অনেক দল বা সংগঠনের যুক্ততা ছিল যারা কিনা তাদের সবধরনের বিরোধিতা ভুলে গিয়ে সবাই মিলে একটি প্ল্যাটফর্মে জোট হয়েছিল এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, আপনার কি মত? এই সংবদ্ধতার কারণ কি বা কীভাবে সংঘবদ্ধ হলো, আপনার কাছে মনে হয় ?
উত্তরঃ এত স্টুডেন্ট যখন মারা গেল, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্পাপ শিশুও বাদ যায়নি। সাধারণ শিক্ষার্থী, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা তো আছেই। একের পর এক এই অমানবিক অত্যাচার। এসব কিছুর উর্ধে আমি কি বলি? সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নেই। মানুষের বিবেকবোধের যে জায়গা, সেখান থেকে আমরা আন্দোলন করেছিলাম। এখন অবশ্য অনেকের মতামত অনেক ধরণের হবে। আমি যদি আমার জায়গা থেকে বলি, আমাদের সকলের সফট কর্নারের জায়গা থেকে চিন্তা করি, আসলে আমাদের কি করা উচিৎ? একজন মানুষ হিসেবে আমার সর্বপ্রথম কাজ কি, যখন একটার পর একটা আমার ভাই, একটার পর একটা আমার ক্লোস পার্সন মারা যাচ্ছে? এই জায়গাটি থেকে দেখলে দেখবো যে, ছাত্রদের পাশাপাশি পথশিশুদের একটি বিশাল সাপ্লাই ছিল। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, বিশেষকরে, শেষের দিন গণপথযাত্রাতে কত মানুষ যুক্ত হয়েছিল। এটি তখনই হয়েছে, যখন সবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছে। তারা ভাবছে আর কত, আমরা আর কত সহ্য করবো। একটির পর একটি বাচ্চা মেরে ফেলা হচ্ছে। রিকশাওয়ালা, পথশিশুকে মারা হচ্ছে। বিরুদ্ধে কিছু বললেই লাঠিয়াল বাহিনী চলে আসছে। এই জায়গা থেকে সবার মতভেদ ভুলে, নিজেদের অন্তরদ্বন্দ্ব ভুলে সবাই এক হয়। আমাদের ওপর এভাবে অমানবিক অত্যাচার চালাচ্ছে কে, এই জায়গাটি থেকে সবাই অংশগ্রহণ করে।
প্রশ্নঃ গণগ্রেফতার বা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া, রাস্তাঘাটে ফোন চেক করা এবং গুলি চালানো, কারফিউয়ের মধ্যে এই যে ঘটনাগুলো হচ্ছিলো অর্থাৎ এই পরিস্থিতে আপনি বা আপনাদের জায়গা থেকে কীভাবে আন্দোলনটি বজায় রাখলেন? এর অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
উত্তরঃ আমার বাসার লোকেশনটি হলো মহাখালী এবং এখানে সেই সময় এমপি ছিলেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। আমি সবসময় আমার ব্যাগে একটি লুঙ্গি এবং একটি গেঞ্জি রাখতাম। আমি যদি কোনো বিপদ দেখতাম, তাহলে এই দুটো পড়ে ফেলতাম। এটি আমার বেসিক ধারণা থেকে করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র আমাকে এই উপদেশটি দিয়েছিল। আমার এলাকার মানুষ খুব কম জানত যে আমি আন্দোলনে যাই। আমি আন্দোলনের গেটআপে যেতাম না, স্বাভাবিকভাবেই যেতাম। কারণ আমি জানি এটি আসাদুজ্জামান খান কামাল-এর এলাকা। উনি আমাকে পেলে জীবনেও ছাড়বে না, আমি গুম হয়ে যাবো। ১৮ তারিখে আমি যখন কোনো মতে পালিয়ে আসি, তখন দেখি সবাই বলছে, কিরে তুই নাকি আন্দোলন করোস? আমি খুব বেশি অবাক হলাম যে, সেদিন কিছু নিউজে দেখাচ্ছিল আমি প্রেসে কথা বলি। এরজন্য এই জোনে যারা ছিল, তারা সবাই জানে যে আমি এই আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করছি।
আমি যখন আসি তখন দেখি, অনেকেই দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রেল লাইনে বসে আছে, যারাই আসবে তাদের পেটাবে। আমার সামনে দুটি মেয়ে ছিল। তাদেরকে অলরেডি চর-থাপ্পর দিয়ে বলছিল, এই আন্দোলনে কেন যাস? আরও অনেক কথা বলে। আমি সেই সময় সেদিকে থেকেই ব্যাক করি। এরপরে আর বাসায় ছিলাম না। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ফ্যাকাল্টি ম্যাম, উনার সাথে কথা বলে আমি তার বাসায় যাই। ম্যাম আমাকে যথেষ্ট সাপোর্ট করেন, ওনার বাসায় আমি চারদিন ছিলাম। আমার বাসায় পরপর দুইবার রেইড পড়ে, তবে একবারও আমাকে পায়নি। সেনাবাহিনী ২১ তারিখে একবার আসে এবং ২৭ বা ২৮ তারিখে একবার আসে। একবার সিভিল ড্রেসে এবং একবার র্যাবসহ আসে। মহাখালীতে আমার পরিচিত যতগুলো মেস ছিল, ম্যাক্সিমাম মেসগুলোয় কেউ ছিল না, সবাইকে ধরে নিয়ে যায়, প্রায় ১০০ শিক্ষার্থীকে ধরে। আমাদের পাশেই সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি কাব্য। আমি মহাখালীর লোকাল এবং আমার লিস্টটি করে কাব্য। কাব্য লিস্ট করে বলে দেয় যে, এই আন্দোলনে ওর একটি স্পেসিফিক ভালো ভূমিকা আছে। আমি তখন লিস্টেড। আমার বাবা মা এখানে থাকে না। আমি আমার বড় ভাইয়ের সাথে থাকি। আমার বড় ভাই তখনও জানে না যে আমি আন্দোলনে ইনভলভড। যখন পুলিশ এসে রেইড দেয়, তখন বুঝতে পারে আন্দোলনে আমার অংশগ্রহণ কতটুক। সেদিন যখন টিভি চ্যানেলে দেখে যে আমি সাক্ষাৎকার দিচ্ছি, দেখে আমার বাবা-মাও অনেক চিন্তিত হয়।
তখন থেকেই আমার ফোন একটানা চারদিন অফ ছিল। সবাই মনে করে যে আমি হয়তো আন্দোলনে কোথাও গুম হয়ে গিয়েছি। সে সময় এলাকার যেসব পাতি নেতা ছিল, তারা গিয়ে আমার বাবা-মা, ভাইকে হুমকি দিয়েছিল যে, আমি যদি আন্দোলনে আর যাই, তাহলে অবস্থা খারাপ হবে। তাদেরও খুঁজে পাবা না। সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাও কর্মসূচিতে আমরা গুটিকয়েক জন যাই এবং আমি সবগুলো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করি। আমি অংশগ্রহণ করতাম, কিন্তু ছাত্রলীগের অনেক বাঁধা থাকতো। ছাত্রলীগের দাবড়ানি, চাটি তো ছিলই; দেখলে কিল ঘুষি দিত। এদিকে আমার একটি প্লাস পয়েন্ট ছিল যে, আমি আমার আইডি কার্ডের ফিতা নিতাম না। আমার জুতার মধ্যে শুধু আইডি কার্ড নিতাম যেন কেউ বুঝতে না পারে যে আমি স্টুডেন্ট। আমি সাধারণ মানুষ হিসেবে ঘুরাফেরা করতাম।
এখন বলি আমার মোটিভেশনটি কোথায় ছিল। এত বাঁধা থাকার পরেও কেন আমার এক্টিভনেস ছিল। যেহেতু আমাদের কোনো রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ডও নেই, আমরা যখন ১৮ তারিখ বনানী ব্লক করে চলে আসি, তখন মহাখালীর রেলগেটের একটি বাচ্চা, তার বয়স সম্ভাবত ১৪ বছর, পথশিশু হবে, ছাত্রলীগের সাথে সেই বাচ্চা আর আমি পিকেটিং অবস্থায় ছিলাম। সেই বাচ্চাটি তখন গুলি খায়, তার একটি সাইডে গুলিটি ঢুকে যায়। আমি তাকে কোলে করে আমাদের মহাখালীর মেট্রো হসপিটালে নিয়ে আসি। প্রচুর রক্ত পড়ছিল ওর, আমার পুরো শরীর রক্তে ভিজে যায়। মাত্র ১২ থেকে ১৪ বছরের একটি বাচ্চা আমাকে বলছিল, “ভাইয়া আমার তো গুলি লাগছে, আমি কি বেঁচে থাকবো?” এ কথাটি এখনও আমার কানে রিপিট হয়। আমাকে সে বারবার বলছিল, “আমি কি বেঁচে থাকবো?” ও এক মিনিট আগেও আমার থেকে পেস্ট (Note, explian) নিয়ে যায়, কারণ সে সময় সেতু ভবনে আগুন দেয়া হয়। আগুন দেয়ার পর পুলিশ আক্রমনাত্নক হয়ে যায়। হেলিকপ্টার থেকে পানি ফেলে যাতে আগুন নেভে এবং টিয়ারশেলের গ্যাসগুলো ভালো করে ছড়ায়। সে সময়ে সেই বাচ্চাটি টিয়ারশেলে পড়ে এবং এরপর ফ্লাইওভার থেকে গুলিটি করা হয়।
আমি ওকে মেট্রো হসপিটালে ভর্তি করি। বাঁচার যে একটি আকুতি! মানুষ মারা যাওয়ার আগে বুঝতে পারে বাঁচার আকুতিটি কি। সে আমার হাত ধরে বারবার বলছিল, “আমি কি বেঁচে থাকবো ভাইয়া?” আরে সমস্যা নেই, বলে ওকে আমি রাখি। ওকে উপরে নিয়ে যাওয়ার একটু পরই ছেলেটি মারা যায়। আমার কোনো নিকট আত্নীয় মারা গেলে যতটা কষ্ট হতো, ঠিক ততটা কষ্ট লেগেছে আমার। আমার মোটিভেশন হিসেবে এটি কাজ করেছে। যদি বলি, আমার জীবনের সব থেকে বড় কষ্ট পেয়েছি কোথার থেকে, আমি বলবো এই জায়গা থেকে। আমি বাচ্চাটিকে মেট্রো হসপিটালে যখন আনি, আমার পুরো শরীর রক্তে ভেজা। মেট্রো হসপিটালের দায়িত্বপ্রাপ্ত যারা ছিল, তারা আমাকে জাস্ট বলেছিল, ওপরে আমাদের ওটি আছে, ওকে ইমার্জেন্সি বুলেটটি বের করতে হবে। ওপরে যখন নিয়ে যাবার ৩০ থেকে ৩৫ মিনিটের মধ্যে আমাকে এসে বললো, He is no more! একজন পথশিশু, ওর বাবা রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি করে মাঝে মাঝে। ওর পক্ষে কে আন্দোলন করবে, ওর পক্ষে কে বিচার চাইবে? ওর পক্ষে আসাদুজ্জামান খান কামাল বা সেই সময়ে যারা এই এলাকার আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কে কেসে লড়বে? তার সঠিক বিচার পাবে? আমি ঘুমাতে পারতাম না। আমি দুই ঘণ্টা ঘুমালেও আমার মনে পড়তো যে আমার সারা গা রক্তে ভেজা; আমাকে বলছে, “ভাইয়া, আমি কি বেঁচে থাকবো?”
ও আমার থেকে বেশি সাহসী। আমি তো তাও পালিয়ে পালিয়ে পিকেটিং করতাম। ও একদম ফ্রন্টলাইনে থাকতো, ওর কোনো ভয় ছিল না। একটি বাচ্চার যদি ভয় না থাকতে পারে, নিজের জীবন দিয়ে দিতে পারে, তাহলে আমি কি। আমি তো ওর থেকে বড়। ও ভয় পায়নি, আমি ভয় পাবো, এটি কেমন কথা? আমার জাস্ট একটি কথাই এখনও কানে ভাসে, “ভাইয়া আমি কি বেঁচে থাকবো, আমি কি বাঁচবো?” ওর সারা মুখে পেস্ট মাখা ছিল।, আমিই পেস্ট দেই। ও জানেও না পেস্ট দিতে হয়। ওর মুখে যখন টিয়ারশেল লাগে, পানি দিচ্ছিল দেখে আমি বলি, এই পানি দিচ্ছিস কেন তুই? তারপর ওর মুখটি মুছে আমি পেস্ট দেই। পেস্ট দিয়েই সামনে যাই। আমরা তো ফায়ার করছে দেখে ফ্লাইওভার পিলারের পিছনে ব্যাকআপ নেই, কিন্তু ও বের হয়ে মারতে যায়। ওর এক সাইডে তখন গুলিটি লাগে। ডান দিকে গুলিটি লাগে। প্রচুর রক্ত বের হয়। আমরা কোনো মতে বডিটি নিতেই পারছিলাম না। ওর যখন গুলিটি লাগে, উঠতে গিয়েও উঠতে পারেনি। আমার দিকে তাকায় ছিল। কোনো রিঅ্যাকশন ছিল না। আমি মনে করেছি স্পট ডেথ। কিন্তু যখন সামনে যাই তখন দেখি, না বেঁচে আছে। সাথে সাথে ওকে আমরা ওখান থেকে নিয়ে আসি।
সে সময় কোনো রিকশা খুঁজে পাইনি। এদিকে প্রচুর রক্ত পড়ছিল। আমার এক বন্ধু ছিল, আমি ওর টিশার্ট খুলে বাঁধি, যাতে ব্লিডিং না হয়। পাশেই মেডিকেল, ৫-৭ মিনিট লাগে যেতে। আমার সব থেকে কষ্টের জায়গাঃ মেট্রো মেডিকেল একে চিকিৎসা দেবে না। আমরা বাধ্য হয়ে মেডিকেলের একটি গ্লাস ভেঙ্গে ফেলি। বলি যে, এ মারা যাবে, আপনি কিসের মধ্যে কি বলছেন? পরে তারা বলে, ছাত্রলীগ নাকি অনেক সমস্যা করবে। আসাদুজ্জামান খান কামাল নাকি তাদের এখানে হামলা চালাবে। সাউথ ইস্টের কাব্য নাকি এসে ঝামেলা করবে। তারা রুগীকে ভর্তি করবে না। আমরা প্রায় ২০-২৫ জন ছিলাম। স্থানীয় আরও অনেকেই ভিড় করে যে একটি বাচ্চা মারা যাচ্ছে, আপনারা এর সাথে কিসের তুলনা করেন! পরবর্তীতে, আমরা অনেক চরাও হয়েছিলাম। আমার মনে আছে, আমরা গ্লাসগুলো ভেঙ্গে ফেলেছিলাম, হসপিটালের কারণে একটি বাচ্চা মারা যাচ্ছে। এরপর তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়। ত্রিশ মিনিটের মধ্যে বা বলতে পারি, আমার হাতের ওপরেই বাচ্চাটি মারা যায়।
বাচ্চাটি মারা যাবার পর মহাখালীতে আগুন দেয়। বাচ্চাটি মারা যাওয়া আসলে টনিকের মতো কাজ করেছিল। রেল লাইনে প্রচুর মানুষ ছিল। মানুষ যখন জানে যে একটি বাচ্চা মারা গেছে, তখন দেখেছি, আমার মতো যত মানুষ ছিল, এক সাথে সবাই রেল লাইনে আক্রমণ চালায়। আমরা যখন আন্দোলন করি, তখন বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ দাঁড়িয়ে থাকতো, দেখতো যে সামনে ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু যখন দেখলো একটি বাচ্চা মারা গেছে, তখন আমার সাথে অনেক মানুষকে আমি পেয়েছি। তার মধ্যে কিছু অন্য এজেন্ডাও ছিল, লুটপাট এসব।
যখন ইন্টারনেট ছিল না, তখন আমরা এসএমএস কিনে নিতাম। এসএমএসের মাধ্যমে কথা বলতাম, কারণ আর কোনো অপশন ছিল না। একটা সময় ছিল, যখন শুধু ওয়াইফাই কাজ করতো। ওয়াইফাইের ডেটা এত স্লো যে আমাদের কাছে আর কোনো যোগাযোগের অপশন নেই। কল দিয়ে কথা বলতে পারি না। তখন আমাদের কাছে একটাই অপশন ছিল, এসএমএস। এজন্য আমরা ওয়েট করছিলাম। আমরা একটু যোগাযোগের সুযোগ পেলে বুঝাতাম যে, আমাদের মধ্যের স্পিডটি হারিয়ে যায়নি। স্পিড একটু কমে যায় ৫-৬ দিন যখন শাটডাউন ছিল। হয়তো বা পোলাপান একটু দমে গিয়েছিল, কারণ আমরা বাঙালী, আমরা কনটেক্স পছন্দ করি। কিন্তু এবার সে জিনিসটি হয়নি। এবার এক্সসেপশনাল ছিল। যখন একটু একটু করে আমরা সবাই নেটওয়ার্ক পাচ্ছি, আমরা দেখেছি এই শাটডাউনের সময়ে কি নির্যাতন চালায়। এটি আমাদের স্পিডকে আরও দ্বিগুণ করে। তখন জনমত, রাজনৈতিক দল, ঘটনা আমরা কিচ্ছু দেখিনি। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক, নির্যাতন হচ্ছে, আমাদের তাই মাঠে নামতে হবে। এটি ছিল সবার গোল। এই লক্ষ্যে সবাই নামে, এ জন্য আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারকে নামাতে পারি।
প্রশ্নঃ যখন আন্দোলনের একপর্যায় এটি ন্যাশনাল স্টুডেন্ট মুভমেন্ট হয়ে গেল তখনও সাধারণ জনগণ তেমনভাবে অংশগ্রহন করেনি; আপনার অভিজ্ঞার থেকে ঠিক কোন সময় সাধারণ জনগণ অংশগ্রহণ করা শুরু করে, আপনার কি মনে হয়? পরবর্তীতে এটি যে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেবে, এরকম কোনো চিন্তা ভাবনা বা আপনি আগে অনুমান করতে পেরেছিলেন কি?
উত্তরঃ ৫ই আগস্টের ঠিক এক ঘণ্টা আগেও সারজিস (Note, description needed) ভাই, নাহিদ (Note, description needed) ভাই, বা আমরা যারা বিভিন্ন সেক্টর ভাগ করে আন্দোলন করতাম, তখন আমাদের সাথে নাহিদ (Note, description needed) ভাই, আসিফ ভাই (Note, description needed) আমাদের উপদেষ্টা হয়ে ওঠেন। কেউ না কেউ আমাদের সাথে যুক্ত হয়। আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোথায়, কীভাবে, কখন আন্দোলন অংশগ্রহণ করবে বা আন্দোলন কীভাবে শুরু করবে, জুমে তারা আমাদের ইন্সট্রাকশন দিতেন। কখনো হাসনাত(Note, description needed) আসতেন, কখনো আবু বাকের (Note, description needed) আসতেন, কাদের (Note, description needed) আসতেন। যে যখন যেভাবে পারতেন, আসতেন। কেউ কারো সাথে ডিসকাশন করে না। এই জন্য হয়তো আন্দোলনটি সফল হয়েছে। যেমন, আসিফ (Note, description needed) ভাইয়ের সাথে আমার যখন দেখা হয়, আমি জিজ্ঞাস করেছিলাম, ভাইয়া আপনি যে একদিন আগে দিলেন পদযাত্রাটা, এটি কি ভেবে দিয়েছিলেন? উনার কাছেও মনে হয়েছিল যে, একদিন আগেই দিয়ে দেই। উনি তখনো জানতেন না যে আমাদের ৫ই আগস্টের পদযাত্রাটির কথা। আমাদের এক্সপেকটেশন ছিল না যে এত মানুষ হবে। মানুষ যে সকল বাঁধ ভেঙ্গে চলে আসবে, আমরা নিজেরাও জানতাম না। আমি যদি বলি, মানুষের সবচেয়ে বেশি পদচারনার কথা বলি, আমি বলবো ২ এবং ৩ তারিখের আমরা সেটা দেখেছি। ২ ও ৩ তারিখে আমরা আন্দোলন শুরু করি। অন্য যে কোনো দিনের চেয়ে ২ ও ৩ তারিখের আন্দোলন ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২ ও ৩ তারিখে, বিশেষ করে ৩ তারিখে শুধু আমরা না, আমাদের সাথে গার্ডিয়ান, শিক্ষক, বিভিন্ন পেশাজীবী অর্থাৎ সকল ধরণের মানুষের অংশগ্রহন ছিল। ৩ তারিখে যখন শহীদ মিনারে পদযাত্রাটি হলো, সেখানে অর্ধেক ছিল শিক্ষার্থী এবং বাকি অর্ধেক ছিল বিভিন্ন সংগঠনকে ব্যবহার করে আসা মানুষ। আবার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের ব্যানার থেকে কেউ এসেছিল গার্ডিয়ান হিসেবে। গার্ডিয়ান, শ্রমজীবী, ও পেশাজীবীর আসাটা এই আন্দোলন সফলের কারণ।
আরও একটি বিষয় হলো, বিএনপি ২০১৩ সালে আন্দোলন করে। এরপর অনেকগুলো আন্দোলন হয়েছিল, তবে একটিও সফল হয়নি। আমরা জানি যে, নির্দিষ্ট ফান্ডিং-এর বিনিময়ে চলার কারণে, অর্থাৎ তুমি আমার আন্দোলনে আসবা, ৫০০ টাকা বা ১০০০ টাকা দিব, আন্দোলন সফল হয়নি। কিন্তু আমাদের আন্দোলনে চাওয়া পাওয়া বা হারানোর কিছু ছিল না। সে জন্য আন্দোলনে অনেক হিউজ ক্রাউড হয়। ৩ তারিখে আমরা যখন এখানে আসি, আমাদের অনেক সাপোর্ট ছিল। গার্ডিয়ানের সাপোর্ট বা সাধারণ মানুষের সাপোর্ট ছিল। পুলিশ আমাদেরকে ধাওয়া দিচ্ছিল, আমরা গলিতে গলিতে পালাচ্ছিলাম। সেই সময় সাধারণ মানুষ আমাদের খাবার দেয়, ওয়াইফাই ফ্রি করে দেয়, পানি দেয়, নানাভাবে আমাদের অনেক সাপোর্ট দেয়।
আমার কি লাগবে, তার জন্য আমার মায়ের মতো ১০০জন মা দাঁড়িয়ে আছে, বাবা দাঁড়িয়ে আছে, ১০০জন বড় ভাই দাঁড়িয়ে আছে। এটি আসলে তাদের চেতনাবোধের জায়গা থেকে আসে। ৩ তারিখের কথা যদি বলি, চেতনাবোধের জায়গা থেকে সকল সাধারণ মানুষের সাপোর্ট সে সময় আমরা পেয়েছি। হাতে গোনা গুটিকয়েক জন বাদে, অর্থাৎ যাদের আইডিওলজি অনেক বাজে, অনেক নিচু। তবে, এই আইডিওলজির বাহিরে যত মানুষ আছে, তারা ৩ তারিখ থেকে পরোক্ষভাবে বা প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়। কেউ আমাদেরকে পানি দিয়ে সাপোর্ট দিয়েছে; আবার আমরা পালিয়ে এলে আমাদেরকে শেল্টার দিয়েছে। কেউ আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমি আমার জায়গা থেকে যা দেখছিলাম, প্রথম থেকে এবং ১৮ তারিখের পর থেকে, সাধারন জনগণের ভালো একটি পার্টিসিপেশন ছিল। তবে আপামর জনতার কথা যদি বলি, ৩ তারিখে শহীদ মিনারে যে ক্রাউড হয় বা ৩ ও ৪ তারিখে অংশগ্রহন সব থেকে বেশি চোখে পড়ার মতো ছিল।
প্রশ্নঃ আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়ার পর যখন ৯ দফা থেকে ১ দফা দাবিতে চলে যায় তখন আপনার মনোভাব কেমন ছিল? কিংবা যখন ১ দফা দাবি উঠে যায়, সেই পরিস্থিতির আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
উত্তরঃ আমরা যখন আন্দোলনের সফলতার কাছাকাছি ছিলাম, তখনও আমরা জানতাম না যে এভাবে আমরা সংসদ ভবন ঘিরে ফেলবো। আমাদের আসলে কোনো আইডিয়া ছিল না। যদি কেউ বলে, আমাদের আইডিয়া ছিল, তাহলে এটি আধ্যাত্মিকতা ছাড়া আর কিছুই না। আমাদের আইডিয়াও ছিল না যে, এত বড় বড় মিছিল নিয়ে এত মানুষ চলে আসবে। মিছিলের একটি মাথা মহাখালী, আর এক মাথা গাজীপুর চলে গেছে। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনো হবে কিনা সন্দেহ। যখন ১ দফাতে চলে আসে, আমি যতটুক জানি, এটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই প্রথম আসে। কেন্দ্র থেকে ডিক্লারেশন দেবার আগেই আমরা ১ দফার দাবিতে আন্দোলন শুরু করি। ভ্যালিডিটির জায়গা থেকে এটি চলে আসে যে ১ দফা এখন সরকার পতনের ডাক হবে। রিফাত রশিদ (Note, description needed) তখন খুব কড়া একটি বাক্যের ভিডিও ফেইসবুকে ছাড়েন যে, এখন শুধুমাত্র ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার পতন ছাড়া আমাদের আর কোনো অপশন নেই, কারণ সে তার সকল লিমিট ক্রস করে ফেলেছে। এখন পর্যন্ত যে এত বাচ্চা শিশু মারা গিয়েছে, তার কোনো অনুতাপবোধ নেই। অর্থাৎ সেই সরকার কখনই আমাদের রক্ষক হতে পারে না, সে ভক্ষক এবং যারা তার সহযোগী, তারাও ভক্ষক। একে পতন করানো ছাড়া এই দেশ পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
তখন হয়তো এটি রিফাত রশিদের মুখ থেকে আসে, তবে এটি আসলে পুরো বাংলাদেশের প্রতিটি সাধারণ মানুষের মনের কথা ছিল। আর কত! এই সরকারকে মেনে নেবার মতো মন মানসিকতা মানুষের আর ছিল না। এর বহিঃপ্রকাশ আমরা অলরেডি ৫ তারিখে দেখেছি, যেখানে সাধারণ মানুষের কি ধরনের ইনফ্লুয়েন্স ছিল। এই জায়গায় আসলে বাংলাদেশের তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকার ব্যর্থ। ক্ষমতার লালসা এমন এক জিনিস! যে, ভুল করছে পরে অনুতপ্ত হতে বাধ্য। তারই তো জনগণ, সে এখন যে দলেরই হোক। তার বিরোধী আন্দোলন করছে , একটি স্কুল কলেজের বাচ্চা মারা যাচ্ছে । তার অনুতপ্তের জায়গাটি বাদ দিয়ে সে দেশের কাঠামো নিয়ে চিন্তিত । তার বিন্দু মাত্র অনুতাপ নেই যে শিক্ষার্থী , সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে । এটির দায়িত্ব তার ছিল । কিন্তু যখন সে তার রক্ষকের জায়গা থেকে ভক্ষকে পরিণত হয়েছে তখন ১ দফাতে আসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না । এই ঘোষণাটি আমরা যখন পেয়েছি তখন আমরা আগে থেকেই জানতাম যে এমনটাই হবে , এটাই হওয়া উচিৎ এবং এটি ছাড়া আর কোনো অপশন নেই । তখন নানা ভাবে আমাদের সাথে ডিলিং করতে চায় যে, তোমাদের সব দাবি মেনে নিব । কিন্তু আমরা তখন দেখলাম, এই শহীদের বা যারা শহীদ হয়েছে তাদের কি হবে যদি এখন আমরা মেনে নেই ! আজ থেকে প্রায় ২ বছর পর হয়তো আবার একই ভাবে ছাত্র হত্যা করবে যেমন টি আমরা গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশের একটি কালচার দেখে আসছি । সে ক্ষেত্রে ১ দফা ছাড়া আর কোনো অপশন ছিল না , আমি মনে করি । এটিতে ফ্যাসিস্ট সরকারের আইডিওলজিস ছাড়া কোনো একটি মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে সে অখুশি ।
প্রশ্নঃ এই আন্দোলনে আপনার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা বা কোনো ট্রাজিক ঘটনা আছে যা আপনাকে সর্বদা অনুপ্রাণিত করবে কিংবা আপনার সারা জীবন মনে থাকবে?
উত্তরঃ ৪ তারিখে বনানী থেকে একটি মিছিল নিয়ে আমরা রামপুরা এবং পরে, রামপুরা থেকে শহীদ মিনারে যাই। বাংলা মটরে তখন অনেক ফায়ারিং হচ্ছিল। শহীদ মিনারে যাওয়ার পর দেখি, বাংলা মটর থেকে শাহবাগে একটি করে রিকশা আসছে আর একটি করে গুলিবিদ্ধ লাশ যাচ্ছে বা একজন একজন করে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মানুষ যাচ্ছে। সেখানে যাওয়ার পর আমার পায়ে রাবার সিসা লাগে। আর প্রায় ১৫টি লাগে বুকে লাগে। আমি সবসময় কালো ড্রেস পড়তাম, ক্ষত হলে যেন বোঝা না যায়। আর ব্যাগে রাখতাম লুঙ্গি আর একটি গেঞ্জি। সেদিন আমারই একজন সহযোদ্ধা, উনি মাদ্রাসাতে পড়েন; উনি গুলিবিদ্ধ হন, ওনার পায়ে গুলি লাগে। ওনাকে হসপিটালে রেখে সন্ধ্যা আটটার দিকে আমরা বাসার উদ্দেশ্যে চলে আসি। ঠিক করি, ওইদিন আমাদের এক ক্লোস বড় ভাইয়ের ভাটারার বাসায় থাকবো। আন্দোলনের সময় আমরা নিজের বাসা বা ক্লোস কারো বাসায় থাকতে পারতাম না। ট্র্যাকিং যেন করতে না পারে সে জন্য আমি তখন সিম কার্ড চেঞ্জ করে অন্য একটি সিম কার্ড ব্যবহার করতাম। ভেঙে ভেঙে চিপাচাপা দিয়ে আসতে আমাদের একটু সময় লাগে। আসার সময় আমরা দেখি, রামপুরায় সবাইকে চেক করছে। ২০ থেকে ২৫ জন পোলাপান সবাইকে চেক করছে। কিছু আছে কিনা দেখে পরে সবাইকে যেতে দিচ্ছে। আমার ড্রেস তখন পুরো চেইঞ্জ, আমি লুঙ্গী এবং টিশার্ট পড়ে সাধারণ মানুষ হিসেবে এসেছি। আমি যখন আসি, তখন ৫ থেকে ৭ জন আমাকেও আটকায়।
আমি মনে করেছিলাম এরা ছাত্রলীগ। আমি বলছিলাম, “এই মিয়া, আমি তো একটা ছাত্র খুঁজে পাইতেছি না, কই এরা?” সেই মুহূর্তে জীবন বাঁচান ফরজ মনে হয়েছে। আমাকে যেভাবেই হোক বেঁচে ফিরতে হবে, পরের দিন আন্দোলনে যেতে হবে। পরবর্তীতে দেখি, তারা আমাকে উল্টা ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং একজন আমাকে মারতে আসছে। আমি বলি, “কিরে!” পরে দেখি, এরা ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট। ওরা আসলে কারা ছাত্রলীগ খুঁজছে। আমাকে যখন ছাত্রলীগ ভেবেছিল, তখন তারা আমাকে বেঁধে অলরেডি একশন নিয়ে ফেলেছিল যে, আমি ছাত্রলীগ, এখন আমাকে পেটাবে। যখন দেখি এরা আমাদেরই পোলাপান, তখন আমার পরিচয় দেই যে আমি অমুক। ইস্ট ওয়েস্টের যারা আমার পরিচিত ছিল নাইম (Note, description needed) থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক যারা ছিলেন, তাদের সাথে যোগাযোগ করি এবং আমার আইডি কার্ডটি বের করি। আমার সাথে যারা ছিল, তারাও আইডি কার্ড বের করলো। পরে সব কিছু দেখার পর ওরা বুঝলো যে আমরা আসলে সাধারণ ছাত্র, কোনো ছাত্রলীগ না। আমি সেই সময় ভয় পেয়েছিলাম যে, এরা হয়তো ছাত্রলীগ, কারণ তখন রাত ৮টা বাজে। তারা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি যে আমি ছাত্র। তখন আমাকে একটি দোকানে বেঁধে রেখে বলে, তোমরা অনেক মানুষ মেরেছো।
আমার ইনস্পিরেশন ছিল এই জায়গা থেকে যে, রামপুরার কিছু কিছু অঞ্চল ছাত্ররা অলরেডি দখল করে নিয়েছিল। ম্যামের বাসা থেকে আসার সময় সাথে যেই ভাইটি ছিল, সে আর আমি ওখান থেকে আমি ফিরে আসি। তখন উনি বাড়িতে যাবেন। গ্রামে পাঠিয়ে দেবার জন্যে তাকে তখন অনেক প্রেসার দিচ্ছে। গ্রামে যাওয়ার সময় ভাটারা থানা পার হওয়ার পরে ওনার কাঁধে একটি গুলি লাগে। উনি আমার সিনিয়র এবং আন্দোলনের সময় অনেক সাপোর্ট দিয়েছিলেন। সে রাতে উনি গুলিবিদ্ধ হন এবং চোখেও স্প্রিঙটার লাগে। উনি এখনো সেই চোখে দেখেন না। চোখে দুবার অপারেশন করা হয়। এখন ডাক্তার বলছে ছানি অপারেশন করতে হবে। এখন সবার কাছে দোয়া এইটাই যে, উনি যেন সুস্থ হয়ে ফিয়ে আসেন। আমি খুব খুশি হই যখন দেখি যে পরের দিন ভাই আসেন নাই। সিনিয়র হলেও উনি যথাসময়ে আন্দোলনে চলে আসতেন। আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো ছিল। আমরা যোগাযোগ না করলেও দেখতাম প্রয়োজনীয় ইনস্ট্রুমেন্টস নিয়ে উনি চলে এসেছেন।
পরে দেখলাম যেউনি আসেননি। তখন কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। এরপরে ৫ তারিখে যখন ১১টা কি ১২টার দিকে নেট আসে, তাড়াতাড়ি উনাকে কল দেই। তার ফ্যামিলি মেম্বার্স ফোন ধরে বলে, উনি চোখে দেখেন না। ওনাকে তখন ভয়ে হসপিটালে নিতে পারেনি, হসপিটালে গেলে যদি কিছু হয়। এই জন্য ওনার চোখের সমস্যাটি অনেক বেশি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, অর্থাৎ ৫ তারিখে রাতে ওনাকে হসপিটালে ভর্তি করে। ওনার চোখে রাবার বুলেট ঢোকার পরেও ওনাকে হসপিটালে নিতে ভঁয় পাচ্ছিল। নিয়ে গেলে বা নেয়ার পথে কিছু করবে কিনা। চোখ নষ্ট করতে রাজি, কিন্তু জীবন নষ্ট করতে রাজি না। এর বিলুপ্ত ঘটানোর জন্যই আমাদের এই আন্দোলন।
প্রশ্নঃ ১৯৬৯, ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান থেকে কি ২০২৪ সালের গনঅভ্যত্থানে কোনো ভিন্নতা আছে এবং থাকলে আপনার কাছে কোন দিক দিয়ে ভিন্ন মনে হয়?
উত্তরঃ ১৯৭০ সালের আগেও বাংলাদেশীরা আসলে সংগ্রামী জাতি। এরা আসলে যুদ্ধ করতে, আন্দোলন করতে পছন্দ করে। ১৯৭০ সালের পরবর্তী গণঅভ্যুত্থানগুলোর সম্পর্কে যদি আমি ছোট্ট করে বলি। ২০২৪ সালের আমাদের অভ্যুত্থানটি ছিল বাকি অভ্যুত্থান থেকে ভিন্ন। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান, ২০০৬ সালের গনঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলের পার্টিসিপেশন ছিল সব থেকে বেশি। এদিক দিয়ে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা কঠিন, আমরা এখন বুঝি। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান, ২০০৬ সালের গণঅভ্যুত্থান কেন ব্যর্থ হয়, আমরা জানি। গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময় যে গোষ্ঠী বাংলাদেশের মসনদে বসেন, তারা সেই পুরনো কালচারে ফিরে যান। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি মটো আছেঃ ফ্যাসিবাদের না, ফ্যাসিবাদী প্রথার বিলুপ্তি। ফ্যাসিবাদী প্রথার বিলুপ্তি আমরা যখন ঘটাতে পারব, তখন আমাদের ঐতিহ্যটি ধরে রাখতে পারবো। এর সম্পর্কে সচেতন নাগরিক হতে হবে। এই জেনারেশন আন্দোলনটি ঘটিয়েছে, যাদের জেন-জি বলে। এই জেনারেশনকে এটি ধরে রাখতে হবে, তাদের সচেতন হতে হবে। গত কয়েক বছর আমরা কি দেখেছি? ভোট দিতে পারছি না ,যাক এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার কথাও যদি বলি, আমি কখনো ভোট দিতে পারিনি, এ নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা ছিলও না। আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে, এরা বিজয়ী হবে। কিন্তু এখন আর আগের মধ্যে অনেক পার্থক্য। এখন রাস্তায় কোনো মুভমেন্ট হলে আমরা প্রশ্ন করি, কেন? সরকার একটি ভুল করলে আমরা প্রশ্ন করি। আমরা যদি এটি ধরে রাখতে পারি, ফ্যাসিবাদের প্রথা বিলুপ্ত করতে পারি, তাহলে এটি স্ট্যাবল করা সম্ভব।
প্রশ্নঃ এই গণঅভ্যুত্থালনের পর একটি সরকার গঠন করা হয়েছে বা একটি শাসন ব্যবস্থায় আমরা আছি; এই শাসন ব্যবস্থায় আমাদের কোনো পরিবর্তন এসেছে কি বা এসে থাকলে তা কি? আমরা কি রাজনৈতিক পর্যায়ের কোনো পরিবর্তন আশা করতে পারি বা রাজনৈতিক নতুন একটি কাঠাম তৈরীর ক্ষেত্রে কি করা যেতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
উত্তরঃ পাখির এই ডানাটি যা ওই ডানাটিও তাই। একটি নির্দিষ্ট দল চাঁদাবাজি করতো এবং গণঅভ্যুত্থান পর এখন আর একটি দল এসে চাঁদাবাজি করে। গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে আসলে লাভ নেই। সেই একই কথা, এটাও যা ওইটাও তা। এখন একজন রিকশাওয়ালাকে ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে, নতুন বা অন্য কোনো দল আসলেও ২০০ টাকা চাঁদা দেয়া লাগবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া আর কোনো অপশন নেই। যখন কেউ নির্বাচন করেন, তখন হলফনামা দিতে হয়। এই হলফনামার ইনকোয়ারি যথাযথ হয় না। গতবার আমরা দেখেছি, মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা ঢাকাতে একটি ছয় তলা বাড়ির হলফনামায় লেখে ২.৫ লক্ষ টাকা। ঢাকাতে তার ছয় তলা বাড়ি এবং হলফনামায় এর উল্লেখ করা ২.৫ লক্ষ্য টাকা! এর পুনর্বিবেচনা করাই হয়নি, এর বিরুদ্ধে কোনো স্টেপই নেয়া হয়নি। মাশরাফী বলেছিল, এটি মিস্টেক কিন্তু এটি মিস্টেক নয়, ইন্টেনশনালী করা।
যেই নির্বাচনে আসুক, তার হলফনামার বিষয়টি অর্থাৎ তার অর্থ কীভাবে আসছে, কীভাবে যাচ্ছে, খুব হার্ড ভাবে তদন্ত করা উচিৎ। আর তরুণদের সুযোগ দেয়া উচিৎ। আমি মনে করি, নতুন যারা আসতে চায়, দেশকে নতুনভাবে দেখতে চায়, তাদের সুযোগ দেওয়া উচিৎ। অবশ্যই আমি সিনিয়রদের রেস্পেক্ট করি। কিন্তু তরুণরা এদেশকে যতটা স্মার্ট ভাবে ভাবতে পারে, আমার বাবা ততটা স্মার্টভাবে ভাবতে পারবে না। আমার বাবা অনেক সিনিয়র। উনি হয়তো বা আমার থেকে ৩০ বছর আগে এই পৃথিবীতে এসেছেন। আমার থেকে ওনার বেশি এক্সপেরিয়েন্স আছে। এর মানে এই না যে, উনি আমার থেকে বেশি স্মার্টলি দেশকে নিয়ে ভাবেন। আমি এক্সপেক্ট করি যে, আমি বেশি স্মার্টলি ভাবি। এখন যদি তরুণদের জায়গা দেয়, হলফনামার বিষয়টি খুব স্ট্রিক্টলি দেখে, ভাল হয়।
আমার বোঝ হবার পর থেকে দেখছি, রাজনীতিতে যারা আসেন তারা ৫ কোটি টাকা খরচ করে প্রতি মাসে ৩০ কোটি টাকা ইনকাম করবে। এটাই তো তাদের লাভ। রাজনীতিকে পেশা মনে করে আসা উচিৎ না। আমি সেবা করবো, এই ইন্টেনশনে রাজনীতিতে আসা উচিৎ। সেক্ষেত্রে, আমি যদি দেখি ছাত্রসমাজ বা বৈষম্য বিরোধী দল কোনো রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটায়, আমি অবশ্যই স্যালুট করবো। আমার মনে হয়, এক রাজনৈতিক দলের আরেক দলকে রাইভাল মনে করা, ক্ল্যাশ করা, এগুলো যেন সবাই এভয়েড করে। নিজেদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করা, নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং রাখা ভাল। আমার এই ঝামেলা হচ্ছে বা আমি প্রব্লেমে আছি, আমি কি করতে পারি, একটি রাজনীতি দলের কাছ থেকে সে বিষয়ে পরামর্শ নিতেই পারি। এরকম সম্পর্ক যদি আমরা তৈরী করতে পারি, এরকম ফ্রেন্ডশিপ আমাদের মধ্যে যদি গড়ে উঠে, তবে ভাল। আবার আর কিছু সেক্টর আছে যা সিন্ডিকেটে চলে। সিন্ডিকেটগুলো বন্ধ করতে হবে। ভোট বাণিজ্য বলি বা সিন্ডিকেট বাণিজ্য বলি, এগুলোতে রাজনৈতিক দল এবং স্থানীয়দের অনেক হাত থাকে। আমরা যদি এগুলো ভেঙ্গে ফেলতে পারি, আমি আশা করি, যোগ্য মানুষগুলোই রাজনীতিতে আসবেন।
এখন যদি আমার নিজেস্ব দর্শন থেকে বলি, বর্তমানে নতুন রাজনৈতিক দল ছাড়া আর কোনো অপশন নেই। আমরা দেখছি, ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল পুনর্বাসিত করছে। সেক্ষেত্রে নতুন রাজনৈতিক দল অবশ্যই আসা উচিৎ। আওয়ামী লীগের কত কর্মী ছিল, কিন্তু হাতে গোনা কয়েক জন পালিয়েছে। এদেরকে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক দলগুলো টাকার বিনিময়ে পুনর্বাসিত করছে। এগুলোকে আগে চিহ্নিত করা উচিৎ-- টাকার সাথে যার ডিলিং, সে কখনই একজন যোগ্য শাসক নয়। এদের বিরুদ্ধে স্ট্রিক্টলি অ্যাকশন নিলে যোগ্য মানুষগুলো আসবে। আমাদের ডিফেন্স ফোর্স একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করে। সেক্ষেত্রে, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া ইলেকশন ফেয়ার বলতে পারবো না। আগে আমরা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ভোট বাণিজ্যের নিউজ দেখেছি। গতবার ঢাকার এক আসনে সালমান এফ রহমান নির্বাচন করেন। তখন অনেক ভিডিও ফুটেজ ছিল যে, উনি প্রকাশ্যে ভোট বাণিজ্য করছিল। সেক্ষেত্রে, সিইসি কি অ্যাকশন নিয়েছিল? কোনো অ্যাকশন নেয়নি। যেগুলোতে ফুটেজ থাকবে, সিইসির কাজ হবে অ্যাকশন নেওয়া, প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়া। এভাবে হার্ডলাইনে না গেলে সিইসি-কে কেউ ভয় পাবে না।