জুলাইয়ের আরেক ইতিহাস: হাতিয়ার মুক্তি
মোহাম্মদ আবেদ আবদুল্লাহ
বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলের প্রান্তে, নোয়াখালীর বুকে বিস্তৃত এক অনন্য সৌন্দর্যের দ্বীপ, হাতিয়া। নদী ও সাগরের আলিঙ্গনে গড়া এই দ্বীপ যেন প্রকৃতির ক্যানভাসে জীবন্ত চিত্রপট। তার বুকেই লুকিয়ে আছে আরেকটি রত্ন, নিঝুম দ্বীপ। এই দ্বীপে প্রকৃতির সমস্ত রূপের যেন ডালা সাজানো। ম্যানগ্রোভ বন, সমুদ্রতট, হরিণের পাল আর শান্ত নিস্তব্ধতা। কিন্তু এই নিস্তব্ধতার নিচে বহু বছর ধরে জমে ছিল ক্ষোভ, ভয় আর বঞ্চনার আগুন।
বিগত দুই দশক ধরে হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ ছিল রাজনৈতিক দখলদারিত্বের এক দুর্গ। স্থানীয় সংসদ নেতা মুহাম্মদ আলী, যিনি নিজেকে “দ্বীপের রাজা” বলে পরিচয় দিতেন, তার একচ্ছত্র ক্ষমতার রাজত্বে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
তার শাসন ছিল মানুষের ওপর চাপিয়ে দেয়া ভয় আর আনুগত্যের খড়গ। জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনের অসহযোগিতা, এবং গ্রামীণ উন্নয়নের নামে দুর্নীতির রাজত্ব।
দ্বীপের মানুষ অন্ধকারে বন্দী ছিল। উন্নয়ন থেমে গিয়েছিল, শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকারহারা মানুষ অবহেলায় ডুবে ছিল, আর সমাজ ছিল নৌকার দাসত্বে ক্লান্ত।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি — আমি সেই দ্বীপ ভ্রমণে গিয়েছিলাম ২০২১ সালের দিকে। সেখানে যেতে সরকারি বরাদ্দের একটি মাত্র সী-ট্রাক, যা কিনা দিনে একবার সকাল ৮টায় ছাড়ত মূল ভূখণ্ড থেকে। তার পর সারাদিন স্পিডবোট চলাচল করত, প্রতি যাত্রীকে দিতে হতো ৫০০ টাকা। মাত্র কয়েক কিলোমিটার নৌপথ যাত্রার জন্য, যেখানে নোয়াখালী থেকে ঢাকার ভাড়া ছিল মাত্র ৪০০ টাকা।
তারপর স্থানীয় রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ঐ দ্বীপে যত রড বা সিমেন্ট যায়, প্রতি টনে ১০০০ টাকা এবং প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে ২০ টাকা করে মুহাম্মদ আলীকে দিতে হতো। এটা শুধু রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রেই নয় — সকল পণ্যের ক্ষেত্রেই একই নিয়ম।
এ যেন দেশের ভেতর আরেকটা দেশে বাস করত হাতিয়ার জনগণ।
কিন্তু ২০২৫ সালের জুলাই মাসে নিঝুম দ্বীপে এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের জন্ম হয়। তরুণ শিক্ষক, সমাজকর্মী ও পরিবেশরক্ষায় অগ্রণী মানুষের নেতৃত্বে শুরু হয় এক শান্তিপূর্ণ কিন্তু দৃঢ় জনজাগরণ আন্দোলন।
ছবি: সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর বাস ভবনে জুলাই আন্দোলনের সময়ে উত্তেজিত ছাত্র-জনতার ভাংচুর।
তারা বলেছিল —“দ্বীপ আমাদের। কারো রাজত্ব নয়। আমরা প্রকৃতির সন্তান; শাসনের নয়, স্বাধীনতার পথে হাঁটব।”
জুলাইয়ে যে “নতুন হাতিয়া” আন্দোলন গড়ে ওঠে, তাতে যেন হাতিয়ার নতুন জন্ম হয়। মানুষ দুর্নীতি, জলদস্যু ও রাজনৈতিক দমননীতির বিরুদ্ধে একত্রিত হয়। তরুণেরা স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তা মেরামত করে, সমুদ্র প্রতিরোধ বাঁধ তৈরি করে, নারীদের জন্য আত্মনির্ভর হওয়ার প্রকল্প শুরু করে।
গ্রামীণ স্কুলে আবার পড়াশোনা শুরু হয়, চিকিৎসা ক্যাম্প বসে, আর দ্বীপের মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শেখে।
জুলাইয়ের বিপ্লব শুধু একটি আন্দোলন নয়, এটি ছিল এক সামাজিক পুনর্জন্ম। মুহাম্মদ আলীর প্রভাব কমতে থাকে, জলদস্যুরা দ্বীপ ত্যাগ করে, প্রশাসনও ধীরে ধীরে জনগণের পাশে দাঁড়ায়।
নিঝুম দ্বীপের তরুণরা এখন নিজেরাই পরিবেশ সংরক্ষণে নেতৃত্ব দিচ্ছে। মাছ ধরার বিকল্প হিসেবে পর্যটন ও কৃষি উন্নয়নের উদ্যোগ নিচ্ছে।
হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপ এখন বাংলাদেশের পরিবর্তনের প্রতীক হয়ে উঠছে।
যে দ্বীপ একদিন ছিল দুঃশাসনের রাজ্য, আজ সেখানে জনগণ নিজের ভাগ্যের পরিবর্তনের চেষ্টা নিজের হাতে করছে।
জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে —
যতই ছোট হোক, ক্ষুদ্র দ্বীপ হোক, যদি মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়, তবু তারা ইতিহাস বদলাতে পারে।




