শহীদ নূর হোসেন এক অমর আত্মত্যাগের নাম!
ডাঃ মুহাম্মদ আবদুল মোহাইমিন (সাইমন)
বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কিছু দিন আছে যেগুলো জাতির আত্মচেতনায় গভীর দাগ রেখে গেছে—তেমনি এক দিন হলো ১০ নভেম্বর, শহীদ নূর হোসেন দিবস। এই দিনটি শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনার স্মারক নয়; এটি গণতন্ত্র, সাহস, প্রতিবাদ ও আত্মত্যাগের প্রতীক হয়ে জাতির হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে আছে।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা কখনোই সহজ ছিল না। বাংলাদেশে বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। ১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশে সামরিক শাসন কায়েম করেন। মানুষের ভোটাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তখন মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রশাসন, শিক্ষা ও রাজনীতি—সব ক্ষেত্রেই ভয়, দমননীতি ও স্বৈরতন্ত্রের ছায়া নেমে আসে।
এই প্রেক্ষাপটে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকা শহর ছিল উত্তাল। দেশের সচেতন নাগরিক, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে একত্রিত হয়। সারা দেশে শুরু হয় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় লেখা হয়, যখন এক তরুণ শ্রমজীবী মানুষ নিজের বুক ও পিঠে লিখে ফেলেছিলেন ইতিহাসের স্লোগান—
“স্বৈরাচার নীপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।”
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে রাজধানীতে হওয়া সেই বিশাল বিক্ষোভ মিছিলে ছিলেন সেই তরুণ—নূর হোসেন।
নূর হোসেন ছিলেন পুরান ঢাকার দরিদ্র পরিবারের সন্তান, পেশায় একজন অটোরিকশাচালক। তাঁর শিক্ষা ছিল সীমিত, কিন্তু চেতনা ছিল বিশাল। তিনি বুঝেছিলেন, গণতন্ত্র মানে শুধু রাজনীতিবিদদের কথা নয়, এটি সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা, কথা বলার অধিকার এবং ন্যায়ের প্রতিশ্রুতি।
মিছিলের দিন নূর হোসেন নিজের বুকের ওপর লিখেছিলেন—“স্বৈরাচার নীপাত যাক” এবং পিঠে লিখেছিলেন—“গণতন্ত্র মুক্তি পাক”।
এই দুটি বাক্যই সেদিনের আন্দোলনের প্রাণস্পন্দন হয়ে ওঠে। যখন মিছিল জিরো পয়েন্ট এলাকায় পৌঁছায়, তখন পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাঁর রক্তে ভিজে যায় ঢাকার রাস্তা। সেই রক্তই যেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্রোধকে আরও তীব্র করে তোলে। মিছিলে যখন যোগ দেন, তখন তিনি জানতেন না যে কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শহীদ হবেন। কিন্তু তাঁর সেই আত্মত্যাগ হয়ে ওঠে এক জাতির জাগরণের প্রতীক।
নূর হোসেনের আত্মত্যাগের খবর মুহূর্তেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের ক্ষোভের আগুন আরও জ্বলে ওঠে। সেই আন্দোলনই পরবর্তীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে স্বৈরাচার এরশাদের।
আজও আমরা যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি, তার পেছনে শহীদ নূর হোসেনের মতো তরুণদের অমূল্য ত্যাগ রয়েছে।
দিবসটিকে প্রথমে “ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর” হিসেবে পালন করা হলেও এখন সারাদেশে “শহীদ নূর হোসেন দিবস” হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়। রাজধানীর জিরো পয়েন্ট এলাকা এখন পরিচিত শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার নামে। রাজনৈতিক দল, নাগরিক সংগঠন ও সাধারণ মানুষ তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গণতন্ত্র অর্জন করা যত কঠিন, তা ধরে রাখা ততই গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের তরুণ প্রজন্ম হয়তো নূর হোসেনকে দেখেনি, কিন্তু তাঁর আদর্শ আজও প্রাসঙ্গিক। যখনই অন্যায়, দুর্নীতি বা স্বৈরাচারের ছায়া সমাজে ঘনিয়ে আসে, তখন নূর হোসেনের আত্মত্যাগ আমাদের স্মরণে আসে, আমরা প্রেরণা পাই।
গণতন্ত্র মানে শুধু ভোটাধিকার নয়, এটি ন্যায়, স্বচ্ছতা ও মানবিক মর্যাদার মূল্যবোধ রক্ষার হাতিয়ার। শহীদ নূর হোসেনের জীবন আমাদের শেখায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে সাহস লাগে; সেই সাহসই ইতিহাসকে বদলাতে সাহায্য করে।



