২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন: স্বপ্ন, সংগ্রাম ও বাস্তবতার গল্প
তাওহিদ তানজিম, ঢাবি গ্রাজুয়েট, গবেষক কর্নেল ইউনিভার্সিটি
২০১৯ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসসি ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। ২৮ বছর পর, ১১ মার্চ ২০১৯-এ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রার্থী হব—কোনো মাদার রাজনৈতিক সংগঠনের ছাত্রসংগঠনের অধীনে নয়, বরং ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক, স্বতন্ত্র রাজনীতির মাধ্যমে।
আমার সমমনা শিক্ষার্থীদের নিয়ে আমরা গঠন করি ছাত্রসংসদকেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম—‘স্বতন্ত্র জোট’। আমাদের লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট—শুধু ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কথা বলা, কোনো গতানুগতিক মাদার রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা পূরণ না করা। আমি ডাকসুর পরিবহন সম্পাদক পদে দাঁড়াই। ইশতেহারে যুক্ত করি কয়েকটি আইডিয়া, যা আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আইডিয়াগুলো ছিল: ১) ক্যাম্পাসে বাইক শেয়ারিং সিস্টেম ২) “লাল বাস অ্যাপ” – রিয়েল-টাইম ম্যাপে বাসের অবস্থান ৩) এক কেন্দ্রীয় অ্যাপে বাস ও বাইক উভয়ের ব্যবস্থাপনা।
কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের জুনিয়র জোবায়েদের সহায়তায় অ্যাপের ডেমোও তৈরি করি। কিন্তু ইশতেহার প্রকাশের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছাত্রলীগের প্যানেল আমাদের আইডিয়াগুলো নিজেদের ইশতেহারে তুলে নেয়। ভাবলাম—চুরি করুক, যদি বাস্তবায়ন হয়, ছাত্রদেরই লাভ হবে। এ ছাড়া ইশতেহারে ছিল ক্যাম্পাসে রিকশাভাড়া নির্ধারণ এবং বাহিরাগতদের সান্ধ্য চলাচল নিয়ন্ত্রণের দাবি, যাতে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ও সাশ্রয়ী পরিবহন সুবিধা পায়।
জুনিয়র ও সমমনা বন্ধুদের নিয়ে মাঠে নেমে প্রচারণা চালাই। দ্রুত জনপ্রিয়তা পাই, কারণ ছাত্ররা চায় পরিবর্তন, চায় নোংরা রাজনীতি থেকে মুক্তি। ব্যানার, পোস্টার ও প্রচারণার সব খরচ বহন করি নিজের টিউশনির টাকা থেকে।
১১ মার্চ ২০১৯ সকাল ৮টা থেকে ভোট শুরু হলেও বাস্তবে অন্য দৃশ্য দেখা গেল। শহিদুল্লাহ হলে ছাত্রলীগ কর্মীরা লাইন জ্যামিং করে, লুডু খেলে, ছাত্রদের ভোট না দিয়ে বাসায় ফেরানোর চেষ্টা করে। বুথে সমস্যার কথা দায়িত্বরত শিক্ষককে জানালে তিনি সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে বলেন, “সব ঠিক আছে।” আমি ছাত্রলীগের ছেলেদের অনুরোধ করলাম—“২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন। ভোট ছাত্রদের অধিকার। দয়া করে ছাত্রদের হক মারবেন না।” কিন্তু তারা শুনল না, বরং হাসল। তখনই বুঝলাম—এভাবে চললে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে না। আসলে তারাও নোংরা সিস্টেমের শিকার; নিজেদের শোষককে ভালবাসে তারা। অথচ চাইলে তারাই নিজেদেরসহ বাকিদের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারত।
পরিচিত অনেকেই জানাল, তারা ভোট দিতে এলেও বুথে ঢুকতে পারছে না। রোকেয়া হলে মারামারি, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে ব্যালট চুরির খবর এলো। বিকেল ১টায় প্রগতিশীল ছাত্র ঐক্য, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, ছাত্র ফেডারেশন, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ ও আমাদের জোট মিলে নির্বাচন বর্জন করি।
রাত ৩টা ২০ মিনিটে উপাচার্য ড. আখতারুজ্জামান ফলাফল ঘোষণা করেন—
ভাইস প্রেসিডেন্ট: নূরুল হক নূর (১১,০৬২ ভোট)
সাধারণ সম্পাদক: গোলাম রাব্বানী (১০,৪৮৪ ভোট)
সহ-সাধারণ সম্পাদক: সাদ্দাম হোসেন (~১৫,০০০ ভোট)
এই ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমরা সন্দিহান ছিলাম। তখন নূর ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তার ওপর টিএসসিতে ছাত্রলীগ হামলা করলে আমরা সম্মিলিতভাবে নূরের পক্ষে দাঁড়াই। নূর আমাদের আলোচনায় আশ্বাস দেন, তিনি নির্বাচন বাতিল চাইবেন এবং বলবেন পুনর্নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জিতবেন। কিন্তু পরদিন রাজু ভাস্কর্যে তিনি কেবল ভিপি ও সমাজসেবা পদ বাদ দিয়ে বাকিদের পুনর্নির্বাচনের দাবি করেন। আমাদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন।
সেখান থেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদে আমরা রাজু ভাস্কর্যে অনশনে বসি। আমি দায়িত্ব নিয়ে ১২–১৫ মার্চ চার দিন টানা অনশনে থাকি। শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়, মা অসুস্থ হয়ে পড়েন উদ্বেগে। বিভাগীয় শিক্ষক ও বন্ধুদের সমর্থন পাই—তারা ঘোষণা দেন, আমি না থাকলে ক্লাস হবে না। অনেকেই আমাকে দেখতে আসেন, শুভাকাঙ্খীরা সাহস জোগান। ১৫ মার্চ রাতে প্রো-ভিসি অধ্যাপক মুহম্মদ সামাদ ও প্রোক্টর অধ্যাপক এ.কে.এম. গোলাম রাব্বানী এসে আশ্বাস দেন, “অভিযোগ শুনব, বিচার হবে, ভবিষ্যতে নির্বাচন স্বচ্ছ করব।” এরপর আমি অনশন ভাঙি।
২১ মার্চ গণিত বিভাগের অধ্যাপক সাজেদা বানুর নেতৃত্বে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। আমরা প্রমাণাদি জমা দিই। কিন্তু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি—অথবা হলেও আমাদের প্রমাণ উপেক্ষা করা হয়।
২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন আমাদের শিখিয়েছে, পরিবর্তন বাস্তবায়ন সহজ নয়। আমরা পরিবর্তন আনতে পারিনি, কিন্তু প্রমাণ করেছি—ছাত্ররা পরিবর্তন চায় এবং সুযোগ পেলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জানে। আজও বিশ্বাস করি, প্রকৃত গণতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি সম্ভব—যদি থাকে সততা, স্বচ্ছতা এবং ছাত্রদের প্রকৃত কল্যাণে কাজ করার মানসিকতা।