কামাল সিদ্দিকীর বই থেকে: পাকিস্তান পরবর্তী বাস্তবতা
ইমরান আবদুল্লাহ
একদিন পুরানো বইয়ের দোকানে ঘুরতে ঘুরতে এক কোণায় পড়ে থাকা এক বই পাই। বইয়ের বিষয়বস্তু যদিও আমার মাথার উপর দিয়ে যাওয়ার মত, মূলত লেখকের নাম দেখে যাকে ধারণা করেছিলাম, তিনি কিনা সেটা ফ্ল্যাপে দেখে নিশ্চিত হওয়ার পরে দাম জিজ্ঞেস করি। দোকানী নামমাত্র দাম বলাতে বুঝে নেই যে, এই বই পড়ার মত আগ্রহী কারো হয়ত চোখে পড়েনি। বইয়ের নাম “ বাংলাদেশে ভূমি সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি “। আর লেখক কামাল সিদ্দিকী।
বেগম খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শাসনামলে মুখ্য সচিবের দায়িত্ব সামলেছেন। উনি যে প্রাজ্ঞ আমলার পাশাপাশি একজন একাডেমিশিয়ান, জেনেছিলাম খন্দকার রাকিব ভাইয়ের কয়েকটা লেখায়। বইয়ের শুরুর দিকের একাডেমিক কাঠখোট্টা আলাপ কোনরকমে চোখ বুলিয়ে যাওয়ার পর এলো আগ্রহ জাগানিয়া অংশ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হওয়া ‘জমিন নিয়ে রাজনীতি ‘। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর মাধ্যমে জমিদারেরা কিভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এমনভাবে শোষণ করে নিঃস্ব করে দিয়েছিল এবং এসব ঘটনাপ্রবাহ সমাজব্যবস্থা, বিচার-আদালত ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল ,তার পিলে চমকানো আলোচনা।
সহজ করার জন্য বলি, জমিদারেরা কৃষকের কাছ থেকে ১০০ টাকা খাজনা আদায় করে ব্রিটিশ সরকারের কোষাগারে জমা দিয়েছেন ২৫ টাকা। বাকি ৭৫ টাকার অধিকাংশই তারা ব্যয় করতেন বাজে কাজে বা আমোদ প্রমোদ করা, ভোজ দেয়া, পতিতা, গায়িকা বা বাইজী রাখা, বিলাসদ্রব্য সংগ্রহ করা, কলকাতা বা অন্যান্য জিলা শহরে প্রাসাদ নির্মাণ করা প্রভৃতির মতো অনুৎপাদক খাতে। বোঝার ওপর শাকের আটির মতো, তার ওপর ছিল বিয়ের জন্য কর, সামাজিক অপরাধের জন্য জরিমানা, কয়েকপ্রকার ব্যবসা চালাবার জন্য টোল ও ট্যাক্স।
জমিদারের বাড়িতে বিয়ে বা শ্রাদ্ধে, কিংবা জমিদারের নতুন গাড়ি বা ঘোড়া কেনার সময়ও প্রজাদের ওপর এক ধরনের আলাদা কর ধার্য করা হতো। জনৈক মুখার্জী পদবীধারী একজন গবেষক একটি করুণ ঘটনার উল্লেখ করেছেন যে, একজন ভূস্বামী তার এক মামলার খরচ মেটানোর জন্য প্রজাদের ওপর প্রচলিত খাজনার আড়াই গুণ টাকা লেভী হিসেবে ধার্য করেছিলেন ।
জমিদারেরা তাদের আয়ের কিছুটা অন্তত: স্কুল ও হাসপাতাল প্রভৃতি স্থাপনে খরচ করেছেন। কিন্তু এধরনের ‘খোঁড়া যুক্তি’ দিয়ে এই সাধারণ সত্যকে ঢেকে রাখা যায়না যে, গত দুশ’ বছর ধরে তাদের ‘জনকল্যাণ’ মূলক কাজের ফলেও ১৯৫১ সাল পর্যন্ত গ্রাম বাংলার শিক্ষিতের হার ১৪ শতাংশের ওপরে ওঠেনি। অপর পক্ষে তাদের পরগাছাসুলভ, অলস ও অস্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রণালী, প্রত্যক্ষভাবে শুধু আর্থিক অপচয়কে উৎসাহিত করেছে তা নয়, বরং গ্রামের সরল মূল্যবোধে অনুপ্রবেশ করে শ্রমের মর্যাদা, মিতব্যয়িতা, আত্মনির্ভরশীলতা প্রভৃতি সদগুণবিরোধী মূল্যবোধকে উৎসাহিত করেছে।
তো এসবের মাঝখানে জমিদারির উচ্ছেদের দাবী এত গুরুত্বপুর্ণ হয়ে যায় যে, ১৯৩৭ সালে এ, কে, ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টি নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টোতে বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ, খাজনা হ্রাস, আবওয়াব বিলোপ, ঋণ সালিশীবোর্ড স্থাপন প্রভৃতির অঙ্গীকার করেছিল । কিন্তু ক্ষমতাসীন হওয়ার পর, ‘কৃষক দরদী’ ফজলুল হক, কংগ্রেস ও মুসলিম জমিদারদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র শুরু করলেন এবং পূর্ববর্তী অঙ্গীকার থেকে প্রায় পুরোপুরি সরে এলেন।
শেষ পর্যন্ত দলের ভেতর ও বাহির থেকে চাপের মুখে গ্রামাঞ্চলের ঋণ ও প্রজাস্বত্বের ওপর আপাতত কিছু সংস্কার প্রবর্তন করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উচ্ছেদের মতো অধিকতর গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নটি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো বুদ্ধিমান ছিলেন তিনি। তিনি এর জন্য একটি কমিশন স্থাপন করেন- যে কমিশন পুরো দু’টো বছর সময় নিয়েছিল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে যে, জমিদারি ব্যবস্থা থাকা উচিত নয়।
এই দাবী দিনকে দিন এত জোরালো হচ্ছিল যে, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের পক্ষে সরাসরি চাষিদের স্বার্থের বিরুদ্ধাচরণ সম্ভব ছিল না। পাকিস্তান যদি পেতে হয়, তবে বঙ্গীয় মুসলিম লীগকে চাষিদের দাবি তুলে ধরতেই হবে। এমন প্রমাণও রয়েছে যে মুসলিম লীগের নিম্নপর্যায়ে জনগণপন্থীরা ভূমি-সংস্কারের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন । এই চাপ বৃদ্ধি পায় এবং মুসলিম লীগকে ‘জমিদার, অবসর প্রাপ্ত সরকারি চাকুরে ও আইনজীবীদের একটি কোটারী’ থেকে মুক্ত করে গণসংগঠনে পরিণত করে।
১৯৪৬ সালে নির্বাচনী ম্যানিফেষ্টোতে মুসলিম লীগ স্পষ্টভাবে, বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদের প্রতিশ্রুতি দেয় । এর ফলে চাষি সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে যে অভূতপূর্ব সমর্থন পাওয়া যায় তাতে মুসলিম লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বলে রাখা ভালো ১৯৪৬ এর সেই নির্বাচনে সারা ভারতবর্ষের মধ্যে কেবলমাত্র বেঙ্গল প্রভিন্সেই মুসলিম লীগ সরকার গঠনের মত একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।
এই চাষীরা, ভ্রান্তিবশত হলেও, হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের পীড়ন ও শোষণ থেকে মুক্তি পাবার আশায় পাকিস্তানকে একটি অবলম্বন হিসেবে বিবেচনা করেছিল। কিন্তু তবু ১৯৪৭ সালের শুরুতে বাংলার মুসলিম লীগ সরকার পুরো ক্ষতিপূরণসহ জমিদারি উচ্ছেদের জন্য ‘জমিদারি দখল ও প্রজাস্বত্ব বিল’ উত্থাপন করে।
শিল্পী: সোমনাথ হোর
এই নতুন বিলটি একটি ‘সিলেক্ট কমিটিতে’ পাঠান হয়। কমিটির অর্ধেকের বেদি সদস্য ছিল জমিদার ও জোতদার, যারা বিল নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক করে । সিলেক্ট কমিটির কার্যবিবরণী ও পরিষদে বিতর্কের বিবরণী পাঠ করলে কৌতূহলোদ্দীপক প্রবণতা ও দলাদলির খবর পাওয়া যায়।
প্রথমত: কংগ্রেসের সদস্যরা জমিদারি রক্ষার প্রশ্নে বিশেষত: ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এই বিতর্কে তারা সম্ভাব্য সকল প্রকার যুক্তি উত্থাপন করে যেমন, ব্যক্তিগত মালিকানার ‘পবিত্রতা’, ‘জমিদারগণ কর্তৃক দেশের প্রকৃত সেবা করার ইতিহাস’, ‘জমিদারি বিলোপ করলে কমুনিষ্টরা ক্ষমতা দখল করে নিবে’, ‘ক্ষতিপূরণ না দিলে কোনো বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ হবে না’ ইত্যাদি । এধরনের প্রতিবাদ মুসলিম লীগ মহলে যে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি এমন নয়। ভূমি সংস্কার ও ভূমি প্রশাসন মন্ত্রী সে সময় প্রকাশ্যভাবে বলেছিলেন যে, ‘ক্ষতিপূরণ না দিয়ে জমি দখল করা ইসলাম বিরোধী কাজ।’ অর্থাৎ মজার ব্যাপার হলো যে, একদল জমিদারকে, যাদের অধিকাংশ আবার হিন্দু ধর্মাবলম্বী, ক্ষতিপূরণ দেয়ার যৌক্তিকতা দেখিয়ে অকাট্য যুক্তি হাজির করা হতে লাগল বিরোধী মুসলিম লীগ মহল থেকে।
অপরপক্ষে বিল থেকে বর্গাদারদের পক্ষে যায় যে সব ধারা সেগুলো বাদ দিয়ে জোতদারি স্বার্থ বজায় রাখার পক্ষেও মুসলিম লীগ সক্রিয় ছিল। তারা এমন সিলিং-এর প্রস্তাব হাজির করল যাতে জোতদাররা নয়, বরং জমিদাররা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দ্বিতীয়ত: এই বিলের বিরোধিতা যারা করেছিলেন, তারা, পার্লামেন্টের খেলায় যতদূর সুযোগ পাওয়া যায় তার সবটুকু সদ্ব্যবহার করে, এর আইনে পরিণত হওয়াকে বিলম্বিত করছিলেন। এমনকি এতে তারা সফলও হয়েছিলেন, কেননা বিল পাশ হতে প্রায় দু’বছর সময় লেগে যায়।
তৃতীয়ত:, মধ্যে মধ্যে কংগ্রেসের সদস্যরা সরাসরি উল্টো আক্রমণ করে মুসলিম লীগ সদস্যদের বিব্রত করে তুলেছিলেন, যাতে তারা জমিদারদের সর্বাধিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেন।
চতুর্থত:, মুসলিম লীগের জমিদার শ্রেণীর সদস্যরা, ‘সরকারি’ সিদ্ধান্তকে স্পষ্টভাবে অগ্রাহ্য করে, জমিদারি রাখার পক্ষে, এবং জমিদারি উচ্ছেদ করলে ‘উপযুক্ত’ ক্ষতিপূরণ দানের জন্য, কংগ্রেসের হিন্দু জমিদার সদস্যদের সঙ্গে মিলিতভাবে যুক্তি দিতে থাকেন । এই আঁতাত হচ্ছিল এমন এক সময়, যখন সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং তার ফলে মুসলিম লীগ-কংগ্রেস বৈরিতা তুঙ্গে বিরাজ করছিল।
সর্বশেষে, মাত্র সামান্য সংখ্যক সদস্য, (মুসলিম লীগের জনগণপন্থী সদস্যরা) ক্ষতিপূরণ দেয়া ও বিল থেকে বর্গাদারদের অনুকূল অংশ বাদ দেওয়ার বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবে উষ্মা প্রকাশ করছিলেন। তাই জমিদারি প্রথা তুলে দেবার পটভূমিকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
দেশবিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের নতুন সরকার কর্তৃক যে সংস্কার বিল উত্থাপিত হয় তা ছিল আর কিছু নয় পলাতক হিন্দু জমিদারদের জমি মুসলমান কৃষকগণ কর্তৃক দখল ও কুক্ষিগত করায় যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তাকে আইনানুগ করার মোটামুটি ব্যবস্থা । যদিও হিন্দুরা প্রচুর সংখ্যায় দেশত্যাগ করেছিলেন (এর ফলে পূর্ববঙ্গে হিন্দু ভূমিধিকারীদের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছিল), তবু এটাকে একেবারে বিনাবাধায় ছেড়ে দেয়া হয়নি।
এদের এক বিপুল অংশ এদেশে রয়ে গিয়েছিলেন এবং সর্ববিধ উপায়ে এই আইন প্রণয়ণের বিরোধিতা করেছিলেন। বিলটিকে আইনে পরিণত করতে যে আড়াই বছর সময় লেগেছিল এবং পরে আইনের যে সামান্য বাস্তবায়ন হয়েছিল সেই সুযোগে এরা নিজেদের ভূসম্পত্তিকে তরল পুঁজিতে পরিণত করার ও ভারতে পাচার করার সর্ববিধ সুবিধা পেয়েছিলেন।
একটি হিসেবে দেখা যায় যে, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মারোয়াড়ী ও হিন্দু শেঠরা গড়ে প্রতি বছর ৬০ কোটি টাকা করে (সাধারণত: স্বর্ণ, খাদ্যদ্রব্য, পাট ও বিদেশী দ্রব্যের আকারে) ভারতে পাচার করেছেন। এদেশ থেকে এত বিপুল হারে সম্পদ পাচার, জমিদারি উচ্ছেদের দ্বারা যে সামান্য উপকার দেখা দিয়েছিল, তাকে বিশেষভাবে নস্যাৎ করে দেয়।
পরিত্যক্ত সম্পত্তি কুক্ষিগত করার যে কথা, বলা হয়েছিল তাও ১৯৪৮ সালের পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন ও পরবর্তীকালের ১৯৬৫ সালের শত্রু সম্পত্তি অধ্যাদেশের দ্বারা ভীষণভাবে সীমিত হয়ে পড়েছিল। তদুপরি, ১৯৫০ সালে লিয়াকত-নেহেরু চুক্তির ফলে, পূর্ব পাকিস্তানে আগত মুসলমান ও ভারতে গমনেচ্ছ হিন্দুর মধ্যে সম্পত্তি বদলের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। অবশ্য, সাধারণ মুসলমান চাষিদের পক্ষে, আইনসম্মতভাবে বা অন্য কোনো উপায়ে, হিন্দুদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির ওপর হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হয়নি।
আসল অবস্থা ছিল এই যে, হিন্দুদের দেশত্যাগ করে ভারতে গমনের ফলে প্রকৃতপক্ষে লাভবান হয়েছিল মুসলমান জমিদার, জোতদার, ব্যবসায়ী, আমলা, ও প্রভাবশালী মুহাজির প্রভৃতিরা। আড়াই বছর ধরে আলোচনা-পর্যালোচনা ও সংশোধনের পর ১৯৫০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিলটি আইনে পরিণত হয়।




