যারা মনে করছেন যে ডাকসুতে শিবিরের ভূমিধ্বস বিজয় ইলেক্টরেটের বা নতুন প্রজন্মের একটি আইডিওলজিক্যাল শিফটের বার্তা বহন করে, আমার মনে হয় তারা ভুল করছেন। ইলেক্টরেটের সামান্য আইডিওলজিক্যাল মুভমেন্ট থাকতে পারে, কিন্তু আমি এটাকে কোনো সিগনিফিক্যান্ট ফ্যাক্টর মনে করি না।
হাসিনা নির্বাচনকে অসম্ভব ভয় পেতেন, হারবেন বলে। হাসিনার বিরুদ্ধে ভোট ছিল সেন্টার–লেফট, সেন্টার, এবং সেন্টার–রাইটে। এই ইলেক্টরেটেও ভোটের বিন্যাসে তেমন কোনো আইডিওলজিক্যাল শিফট ডাকসুতে ঘটেনি বলে আমার ধারণা। বরং শিফট ঘটেছে প্রার্থী বা দলগুলোর আইডিওলজিক্যাল অবস্থানের (পারসেপশনের) মধ্যে।
“ইসলামী ছাত্রশিবির” গত এক বছরে নিজেদেরকে “সেক্যুলার ছাত্রশিবির” হিসেবে প্রজেক্ট করার চেষ্টা করেছে এবং ক্যাম্পেইন চালিয়েছে। এই প্রচারণার সততা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু ফলাফল ও সমর্থন দেখে মনে হয় এই প্রচারণা কার্যকর হয়েছে। শিবির তাদের রাজনৈতিক অবস্থানকে বামঘেঁষা হিসেবে উপস্থাপনে সফল হয়েছে—প্রজেকশনটি মিথ্যা হলেও ইলেক্টরেট সেটি ধরতে ব্যর্থ হয়েছে।
ছাত্রদল (আদতে বিএনপি) আরও বামমুখী হয়েছে। সচরাচর সেন্টার–রাইট দল হলেও, আওয়ামী ভ্যাকুয়ামে নিজেদের অ্যান্টি–আওয়ামী রাজনীতির কার্যকারিতা হারিয়ে বিএনপি আওয়ামী রাজনীতিকেই নিজেদের করে নিয়েছে। একদিকে এই শূন্যতা, অন্যদিকে ফ্যাসিবাদের হাতিয়ার “৭১-এর আওয়ামী বয়ান”–এর বাইনারি রাজনীতি—সব মিলিয়ে তারা নিজেদের ভোটারদের দূরে ঠেলে দিয়েছে। ঢাবি ছাত্রদলের মধ্যে নতুন ধরনের রাজনীতির চেষ্টা দেখা গেলেও, বিএনপির প্রতি জেন–জেড প্রজন্মের পারসেপশন তাদের জন্য কাল হয়েছে।
রাজনৈতিক বিকল্প হিসেবে হাজির হওয়ার চেষ্টা করা বাগছাস বা অনুরূপ দলগুলো সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ট্রাস্ট তৈরি করতে পারেনি; বরং “২৪-এর চেতনা” ভিত্তিক শিবিরবিরোধী রাজনীতি তাদের জন্য বুমেরাং হয়েছে। চেতনার মালিকানার একচেটিয়াত্বের অভাবে “২৪-এর চেতনা”র বাজারমূল্য কম—কারণ সবারই নিজস্ব “২৪” আছে। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বোঝাপড়ার অভাবে তারা ভুল রাজনীতির শিকার হয়েছে। এর সঙ্গে ছিল স্ট্র্যাটেজিক দিকনির্দেশনা ও এলাইনমেন্টের ভয়াবহ ঘাটতি—নিজেদের প্রার্থীদেরকেই এক লাইনে রাখতে না পারা ভোটারদের ভুল বার্তা দিয়েছে।
টাকা ও সাংগঠনিক দক্ষতা নির্বাচনের মাঠে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। ফেসবুক প্রচারণা ও বট–ফোর্সের মাধ্যমে ছাত্রশিবির নিজেদের বয়ান প্রভাবশালী রাখতে পেরেছে। এর ফলে নির্বাচনে টক্সিসিটির নতুন মাত্রা তৈরি হলেও, এই প্রক্রিয়াতেই সোশ্যাল মিডিয়া যুগে বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রবেশ ঘটেছে। এছাড়াও বিভিন্ন সাংগঠনিক অনুষ্ঠান ও ভোজের মাধ্যমে শিবির ভোটারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে সফলভাবে। জামায়াতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক ইকোসিস্টেম এখানে বড় সহায়ক হয়েছে।
আরেকটি সম্ভাবনা হলো নতুন প্রজন্মের হাত ধরে বাংলাদেশ পোস্ট–আইডিওলজিক্যাল রাজনীতিতে প্রবেশ করছে, যেখানে মতাদর্শ একা ভোট টানতে যথেষ্ট নয়। শক্ত প্রমাণ না থাকলেও, শিবির–ভোটারভর্তি সিনেট ভবনে উচ্চস্বরে “ধনে-ধান্যে” গান গাওয়া এবং শিবির প্যানেলে জুমা বা সর্বমিত্রের সরব উপস্থিতি এই ইঙ্গিত বহন করে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: উপরের সকল আইডিওলজিক্যাল অবস্থান বাংলাদেশে প্রচলিত মেইনস্ট্রিম বাম/ডানের স্পেকট্রামের সংজ্ঞার ভিত্তিতে লেখা, প্রকৃত ডান/বামের সাথে এগুলাকে মিলাতে চাওয়া অর্থহীন।