প্রায় সাড়ে ছয় বছর পর এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর হয়তো আমার লেখাটি প্রকাশিত হবে। তাই এবারের ‘ডাকসু’ নির্বাচন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ অনাবশ্যক মনে করি। ‘ডাকসু’ ঘিরে আমি আমার স্মৃতির মাঝেই থাকবো। ‘ডাকসু’ শব্দটি আমার কাছে নিবিড় এবং প্রিয়। ঢাকা শহর থেকে বহুদূরের বৈদ্যুতিক আলো ও প্রায় টেলিফোন বিহীন নিভৃত শহরে বাস করা সত্বেও স্কুল জীবন থেকে ‘ডাকসু’ শব্দটির সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম। ‘ডাকসু’ মানেই বাংলাদেশের রাজনীতির ‘আতুড়ঘর’। ‘ডাকসু’কে বিরাট একটা কিছু ভাবতে শুরু করি সম্ভবত ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে। আমি তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্র। আমাদের বাড়িতে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা রাখা হতো। রাজনীতির খবরের আদ্যোপান্ত পাঠ করতাম। ‘ডাকসু’ নির্বাচন হলে সেই খবরও থাকতো।
ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিজয়ী ভিপি ও জিএস কে হলেন, তাদের নাম পাঠ করলেই মনে হতো তারা আমার পরিচিত। ছাত্র সংগঠন সম্পর্কে কোনো ধারণা হয়নি তখন। যারা ওই দুটি পদে যারা জিততেন, তাদের নাম মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল, এখনো তা মনে আছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ১৯৭০ সালে যখন ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, একটি প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী আমার পরিচিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেড়াতে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। কিন্তু তিনি নির্বাচনে পাস করতে পারেননি।
প্রতিবছল ‘ডাকসু’ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গত ৫৪ বছরে ‘ডাকসু’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র আটবার। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম ‘ডাকসু’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে। ছাত্র লীগকে পরাজিত করে ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মাহবুব জামান যথাক্রমে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে ‘ডাকসু’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও শেষপর্যন্ত ফলাফল ঘোষণা হয়নি। কারণ কয়েকটি হলে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল। সেবার ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন একজোট হয়ে প্রার্থী দিয়েছিল নতুন শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের উত্থানে। সে উত্থান ঠেকানোর জন্যই ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছিল ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন সমর্থকরা।
আমি ১৯৭৩-১৯৭৪ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেশন জটের কারণে আমাকে বা আমার ব্যাচের সকলকে কার্যত ভর্তি হতে হয়েছে ১৯৭৪ সালে। ক্লাস শুরু হয়েছিল সম্ভবত ১৯৭৪ এর সেপ্টেম্বর মাসে। ১৯৭৩ সালের পর ডাকসু নির্বাচন বন্ধ ছিল। ওই সময় যদি সেশন জট না থাকতো, তাহলে আমার অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করার সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও অ ‘ডাকসু’র কোনো নির্বাচন দেখার সুযোগ হতো না। (সেশন জটকে কি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত?) কিন্তু কলা ভবনের পূর্বদিকের উইং এর নিচতলায় কয়েকটি রুম জুড়ে ‘ডাকসু’ অফিস প্রভাবশালী ছাত্রনেতাদের উপস্থিতিতে সরগরম থাকতো।
আমি প্রথম ডাকসু নির্বাচন দেখার সুযোগ পেলাম ১৯৭৯ সালে। তখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে জাসদ ছাত্রলীগের দোর্দন্ড প্রতাপ। কারণ ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের তেমন অস্তিত্ব ছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্র ইউনিয়ন যেহেতু ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছিল এবং শেখ মুজিবের ‘বাকশাল’ এর সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নের মুরুব্বি সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি অফ বাংলাদেশ (সিপিবি) মিলিত হয়েছিল, অতএব ছাত্র ইউনিয়নের অবস্থাও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ছিল না। অতএব ১৯৭৩ এর ছয় বছর পর ১৯৭৯ সালের ‘ডাকসু’ নির্বাচনে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান যথাক্রমে ভিপি ও জিএস পদে নিবাচিত হন। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রলীগের ওবায়দুল কাদের ও বাহালুল মজনুন চুন্নু। ছাত্রত্বের পাশাপাশি আমি যেহেতু সাংবাদিকতা করতাম, সে জন্য ছাত্রনেতাদের কাছে আমার এবং আরো ক’জন ছাত্র-সাংবাদিকের বাড়তি কদর ছিল। তবে ব্যতিক্রম ছিল, তারা আর আমার কৈশোরের কল্পনার ‘ডাকসু’ ভিপি ও জিএস ছিলেন না। বরং বলা যায়, আমার মতো নিয়মিত ছাত্রও ছিলেন না। তারা ‘ডাকসু’র ভিপি বা জিএস হওয়ার জন্য ছাত্রত্বের মেয়াদ প্রলম্বিত করেন ভিন্ন কোনো সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে। মান্না ও আখতার তাই করেছিলেন। আমি ভোট দিতে যাইনি।
১৯৮০ সালেও ‘ডাকসু’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। আগের বছরের মতো এবারও ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হলেন যথাক্রমে মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান। ছাত্রলীগের ভিপি প্রার্থী ওবায়দুল কাদের ও জিএস প্রার্থী ছিলেন বাহালুল মজনুন চুন্নু। ছাত্রদলের প্রার্থী ছিলেন গোলাম সারোয়ার মিলন ও জিএস প্রার্থী ছিলেন এম এ কামাল। আশি সালের নির্বাচনে আমার জন্য চমক ছিল ইসলামী ছাত্রশিবির থেকে ‘ডাকসু’র ভিপি পদে আমার রুমমেট, সহপাঠি ও প্রিয় বন্ধু তাহের ভাই (মরহুম) প্রার্থী হওয়া। তার রানিং মেট বা জিএস পদে একই ব্যাচে অর্থনীতি বিভাগের আবদুল কাদের বাচ্চু। বন্ধুত্বের অধিকারে তাহের ভাইকে তিরস্কার করেছিলাম ‘ডাকসু’ নির্বাচনে তার প্রার্থী হওয়ার ঘটনায়। তিনি বলেন, সংগঠনের সিদ্ধান্ত, আমার করার কিছু ছিল না। তাছাড়া শক্তি প্রদর্শন করার একটি ব্যাপার আছে। ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা কমবেশি সাড়ে ৭ হাজার।
উল্লেখ করেছি, আমি ছাত্র ও সাংবাদিক ছিলাম। ছাত্রদের মধ্যে কোন ছাত্র সংগঠনের সমর্থন কতটা, তা আমার ভালোভাবে জানা ছিল এবং তা হল-ভিত্তিক ও বিভাগ-ভিত্তিক সমর্থন সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা ছিল। তাহের ভাইকে বললাম, খুব বেশি হলে ৫০০ ভোট পাবেন এবং আমি নিজেও ভোট দিতে যাব না, সেজন্য ক্ষমা করবেন। তিনি কিছু বলেন না। তার স্বভাবসুলভ হাসেন। যাহোক, আমার ধারণার চেয়ে শ’খানেক বেশি ভোট পেয়েছিলেন তাহের ভাই। হল সংসদগুলোতে কেবল এসএম হল ছাত্র সংসদের সদস্য পদে ওমর ফারুক নামে শিবিরের একজন নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি শিবিরের প্রার্থীর চেয়ে তার ভদ্রতা, অমায়িকতা ও মেধাবী ছাত্র হওয়ার কারণে জয়ী হয়েছিলেন।
এবার ডাকসু নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের। এখন ভোটার সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক চালচিত্র সম্পর্কে আমার ধারণা নাবালকসুলভ হয়ে গেছে। তা সত্ত্বেও গণমাধ্যমে শিবিরের মাঝে ডাকসু নির্বাচনে বিজয় অবশ্যম্ভাবী ভাবার উচ্ছাস লক্ষ্য করে তাহের ভাইকে যেমন শুধু শক্তি প্রদর্শনের জন্য ডাকসু নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার যে পরামর্শ দিয়েছিলাম, এখন পরামর্শ দেওয়ার জন্য আমার কোনো প্রিয়পাত্র নেই, এমনকি তাদের মধ্যে আমার পরিচিত কেউও নেই। শক্তি প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা বিপদকে আমন্ত্রণ না করুক, ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো জটিলতার উদ্ভব না হোক, এ আশা করি।