গুম-খুনের বিচার কেন জরুরি
মো. রাকিব উদ্দিন
একটা কথা প্রথা প্রচলিত আছে—স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ক্রসফায়ারের শিকার বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা সিরাজ শিকদার, আর প্রথম গুম-খুনের শিকার চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে এটা জানি তখনও বাংলাদেশ ফ্যাসিস্ট শাসন দেখেনি; দেখেছে ভয়াবহ স্বৈরতন্ত্র।
বাংলাদেশে ফ্যাসিজমের শুরু কখন থেকে হয়েছে, সেটা বিস্তর গবেষণার বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ কখন, কবে ফ্যাসিজমের দিকে যাত্রা শুরু করেছে সে বিষয়ে আমার একটা পর্যবেক্ষণ আছে।
র্যাব যখন গঠন করা হয়, র্যাট-এর পর, ২০০৪ সালের দিকে—বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে—তখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ। সারাদেশে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় অসংখ্য সশস্ত্র গ্রুপ ছিল, যারা নিয়মিত গোলাগুলি ও চাঁদাবাজি করতো। এই প্রেক্ষাপটে র্যাব গঠন করা হয়।
এইটাতে যুক্তরাষ্ট্র বেশ খুশি হয়ে অংশগ্রহণও করেছিল—অনুদান বাড়িয়ে দিলো, ট্রেনিং দিলো। এমনকি পাবলিকও খুশি ছিল। তখন নিয়মিত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছিলো, কিন্তু ক্রসফায়ারটা আর অত উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেনি। কেউ দরকার মনে করেনি। তখনকার সরকার ও বুদ্ধিজীবীরা ভেবে উঠতে পারেনি, এই বিচারহীনতা নিজেদের দিকেই ফিরে আসবে।
এরপর পদ্মা-মেঘনায় অনেক পানি গড়িয়ে গেল। র্যাবের কাজ হয়ে উঠলো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধীদের গুম করা, থ্রেট দেওয়া, বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা। এবং একটা গল্প তো আছেই—সব ঘটনা শেষে, বন্দুকযুদ্ধে নিহত।
যেই যম বিএনপি তৈরি করলো, একটা সার্বভৌম শক্তি দিয়ে, সেটা কিনা তাকেই গ্রাস করলো। এখান থেকে তো আমাদের শেখা উচিত কেন নিয়ম, আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়া জরুরি। এই কারণে জরুরি—যেন ভবিষ্যতে আপনিও অনিয়মের ঘেরাটোপে পড়ে প্রাণ না হারান। ফলত, আমরা একটা বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আওয়ামী লীগের ও আওয়ামী লীগের যাবতীয় ক্রাইম ও গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচার হওয়াকে জরুরি বলি। এর বিকল্প নেই কোনো।
বিচার ব্যাপারটা আসলে খুবই জরুরি। সেনাবাহিনীর সাথে সরকারের যে দূরত্ব, তা মূলত বিচার নিয়েই। সম্প্রতি গুম কমিশনের যে ডকুমেন্ট আমরা দেখলাম—এটা কেন প্রতিটা ইউনিয়নে বিশটা স্পট তৈরি করে প্রদর্শন করা গেল না?
আপনি যদি আওয়ামী লীগকে বিচার করতে চান, ওর জুলুমের স্মৃতি তো আপনার জনপরিসরে সবসময় দগদগে রাখতে হবে। এটা নিয়ে না আছে গভর্নমেন্টের উদ্যোগ, না আছে দলীয় উদ্যোগ! আপনি যখন পাবলিককে এই নিপীড়নের স্মৃতিগুলোর সামনে ধরবেন, তখন বিচারের জরুরতটা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ডিপস্টেট আরো দুর্বল হবে।
এই সরকারের নানান ব্যর্থতা ও অযোগ্যতা বিচারের ক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলছে। নেগোসিয়েশনে গিয়ে উনারা ভাবলেন ঝামেলা এড়িয়ে যাবেন, কিন্তু এতে করে দুর্বল হলেন। ডিপস্টেটের সাথে নেগোসিয়েশন করার মানে হলো দাসখত দেয়া। ফলে, গুমের এভিডেন্স বেশিরভাগ নষ্ট করে দেয়া হলো। কারা করলো? এটা তো দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? এদের তালিকা পাবলিককে কি জানিয়েছে? না! এটা তো পাবলিকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সাথে বেঈমানি।
জনগণ এই উপদেষ্টাদের এই কারণে গদিতে বসায়নি যে, তারা সমঝোতা করবে! যদি সরকার শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারতো, জনগণের উপর আস্থা রাখতো, তাহলে মাসের পর মাস সেনাবাহিনীর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার সেনা আদালতে হবে নাকি ট্রাইব্যুনালে হবে—এটা নিয়ে দরকষাকষি করতে হতো না।
সরকার শক্তিশালী থাকতো। সেনা হেফাজত থেকে গণহত্যাকারীরা কীভাবে বিদেশে চলে যায়, এর কৈফিয়ত দিতে হতো।
এখন কী দেখলেন? সেনা হেফাজতে নেয়া ১৫ আসামির ট্রাইব্যুনালে হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি দেখা গেল। সেনাবাহিনী যে হস্তান্তর চায় না, সরকারও যে এবারও সমঝোতা করলো—এটা বুঝবেন সেনানিবাসেই অস্থায়ী কারাগার বানানোর ঘটনা দিয়ে। ধারণা করি, এই কারাগার সেনাবাহিনীর আসামিদের জন্য। তো এই জমিদারি গভর্নমেন্ট ও সেনাবাহিনী রক্ষা করে চলেছে।
সেনাবাহিনীর অফিসাররা যদি দেখে, সে অপরাধ করে সেফ এক্সিট পায়, এটা সম্ভব না হলে নানা উপায়ে তার বাহিনী তাকে রক্ষা করে—তাহলে ক্রাইম করতে সে উৎসাহী হবে না কেন? কী বাঁধা দেবে? ভবিষ্যতে বিএনপি বা অন্যান্য সরকারই কেন জনগণের উপর জুলুম-নিপীড়ন করে টিকে থাকতে চাইবে না? আমলারাও কেন বা সহযোগিতা করবে না? তাদের তো বিচারের ভয় নেই। উল্টো বেনিফিট বাড়ার সম্ভাবনা আছে।
কেউ কেউ বলছিল, আওয়ামী লীগের সাপোর্টার অনেক, দিনদিনই বাড়ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে বুঝলেন? দোকানপাটে আওয়ামী লীগের পক্ষে লোকজন কথাবার্তা বলে। আমি বললাম, এরা আগেও আওয়ামী লীগ সাপোর্ট করতো, আরো আট-দশ বছর করবে। মাঝে বছর-ছয় মাস নীরব ছিল। কী এদেরকে এখন সরব করছে? সরকারের ব্যর্থতা।
ওরা দেখছে, গণহত্যার সমর্থক হয়ে দিব্যি সবকিছু করা যায়। এমনকি গণহত্যার মূল আসামিদের কেউই বিচারের আওতায় নাই। ফলে তাদের সাহস বেড়েছে। আট-দশ বছর পর বন্ধ হবে কেন ও কীভাবে? যদি আওয়ামী লীগের থেকে আর অর্থনৈতিক ফায়দা নেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়, এরা অযথা আর আওয়ামী লীগ সমর্থন করবে না। কিন্তু এটা করতে পারবে তো?
এইরকম আরো নানা কারণে বিচার আমাদের জন্য জরুরি। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে নাহিদ ইসলামই প্রথম সামরিক বাহিনীর চোখ পাকানো উতড়ে গিয়ে বিচারের জন্য বলিষ্ঠ স্টেটমেন্ট দিলেন। এর বহু পর চক্ষুলজ্জায় বিএনপি-জামায়াত দিছে। ওরাও ইন্টারিম সরকারের মতো সমঝোতার পথ বেছে নিয়েছে।
কিন্তু সমঝোতা জিনিসটা কাদের সাথে হয়, এইটা তো স্পষ্ট হওয়া দরকার। জালিমের সাথে সমঝোতা হয় না। সমঝোতা হবে মজলুমদের মধ্যে। জালিমের সাথে সমঝোতা মানে জুলুমের অংশীদার হওয়া। এই কারণে এখনো গুমের ভুক্তভোগীরা স্বাক্ষ্য দিতে ভয় পাচ্ছে। ওরা ভাবছে, ওদের উপরে এজন্য প্রতিশোধ নেওয়া হবে। এটা তো ভুল না।
আপনারা যখন সামরিক বাহিনীর সাথে সমঝোতা করবেন—যারা ক্রিমিনালদের রক্ষা করছে, বিচার চায় না—যারা বিচারে সহযোগিতা করবে, তাদেরকে যে আক্রমণ করা হবে না, এর তো নিশ্চয়তা নেই; যেহেতু প্রশাসনে এখনো তারা দিব্যি আছে।
মানে, আওয়ামী লীগ যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে গুম ও ক্রসফায়ারগুলো করতো, এটা কমানো গেল না। এটা সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা। ভয়াবহ ঘটনা!
গুম কমিশনের আরেকটা বিষয় খেয়াল করা জরুরি—ভারত ও বিএসএফের যুক্ত থাকা। একে দেখবেন, এতো হাইলাইট করা হচ্ছে না। এটা সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। যদি ভারতকে বিচারের আওতায় না আনা যায়, এই ধরনের জুলুম এরা বন্ধ করবে না। অন্তত আপনার পুরো পৃথিবীতে জানানো দরকার, আওয়ামী লীগের আমলে ভারত কোন কোন দিক থেকে, কত জঘন্যভাবে আওয়ামী লীগের জুলুমে সহযোগিতা করছে। এটা করতে পারলে ভারতের বাংলাদেশবিরোধী প্রোপাগান্ডার প্রভাব কমতো।
শেষে এসে একটা ষোলো বছরের ছেলের কথা বলি। যে কেবল কাঁদত। তার কান্নার স্মৃতি অন্য ভুক্তভোগীরাও ভুলতে পারেনি। কিন্তু সেই ছেলে ভুলতে চায়। তার নখগুলো তুলে ফেলছে হাসিনার পোষা কুকুরেরা। এই ছেলে ঠিকঠাক কথা বলতে পারে না। কথা জড়িয়ে আসে। কথা বলতে বললে সবকিছু অস্বীকার করতে চায়। মানে সব ভুলে যেতে চায়। পারে না!
এই ছেলেকে যদি আপনি ন্যায়বিচার না দিতে পারেন, তার মতো অন্যান্য ভুক্তভোগীরা যদি আবারও গুম-খুনের ভয়ে থাকে, তাহলে তাদের জন্য জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলটা কোথায়? কী লাভ হলো তাদের?
তার ফসল কারা ভোগ করলো, কাদের জন্য তারা এই যন্ত্রণা আজীবন বয়ে যাবে—এর জবাব তো তাদের দিতেই হবে।




