পি আর পদ্ধতি ও জামায়াতের বিপদজনক অবস্থান
আসিফ শাহান
সংস্কার উদ্যোগে বিএনপির অবস্থান নিয়ে শুরু থেকেই আমি সমালোচনা করেছি এবং এখনো করছি। সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পি আর পদ্ধতি আমি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করি কেননা এটি নির্বাহী আধিপত্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে।
আমি জানি নির্বাহী একাধিপত্যকে রুখতে একাধিক শক্তিশালী, স্বাধীন, নজরদারি/খবরদারি করার মত প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন রয়েছে। এক্ষেত্রে এনসিপির অবস্থানকে আমি সমর্থন করি। আমি জানিনা বিএনপির সংস্কার উদ্যোগ কিভাবে কর্তৃত্ববাদের উত্থানকে প্রতিরোধ করবে। তারপরও একটি বিষয়ের জন্য আমি বিএনপিকে কৃতিত্ব দেব যে দলটি একটি “সৎপক্ষ” হিসেবে ঐকমত্য কমিশনের সভাগুলোতে অংশগ্রহণ করেছে।
বিএনপি স্পষ্টভাবেই বলেছে যে কেন কিছু বিষয়ে তারা একমত নয় (যদিও তাদের যুক্তির সাথে আমি একমত নই) এবং এক্ষেত্রে তারা তাদের অবস্থান “নোট অব ডিসেন্ট” সহ উপস্থাপন করেছেন। আশা করি আমরা ঐসকল মতানৈক্য কমিয়ে আনতে সক্ষম হব। বিএনপির ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড এবং সংস্কার বিষয়ে তাদের অবস্থান নিয়ে অন্যান্য দলগুলো কেন সন্দিহান সেটাও বোঝা যায়। কিন্তু যেটা বুঝতে পারিনা সেটা হচ্ছে বিশ্বাসের প্রশ্নে জামায়াত কেন “ফ্রি পাস” পাচ্ছে। কেন আমরা ভাবছি দল হিসেবে জামায়াত কাঙ্ক্ষিত সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে এবং ক্ষমতায় আসলে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। কেন আমরা ভাবছি বা জামায়াতকে বিশ্বাস করছি যে ক্ষমতায় আসলে তারাও কর্তৃত্ববাদি হয়ে উঠবে না।
জামায়াতের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ড এবং উদ্যোগ, বিশেষত ডাকসু এবং জাকসু নির্বাচনে বিজয়ের পর, আমাকে ভাবিয়ে তুলছে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি।
প্রথমত, একদিকে অন্যান্য দলগুলো একরকম আস্থা রাখছে যে জামায়াত জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে (যেহেতু তারা এ ব্যাপারে ঐকমত্য কমিশনে একমত হয়েছে) আর অন্যদিকে দলগুলো ভুলে যাচ্ছে যে জুলাই সনদে নিম্নকক্ষে পি আর অন্তর্ভুক্ত নয়, যেটি ক্রমেই জামায়াতের প্রধান দাবি হয়ে উঠছে।
জামায়াত কিভাবে জুলাই সনদে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে পারে যেখানে একই সাথে এমন একটি দাবিতে আন্দোলন করছে যেটি এই সনদের অন্তর্ভুক্তই নয়। এক্ষেত্রে দলটির অবস্থান কোথায়? দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতলে দলটি এইক্ষেত্রে কি করবে? তারা কি নিম্নকক্ষে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি পরিবর্তন করবে?
দ্বিতীয়ত, নিম্নকক্ষে পি আর-এর ক্ষেত্রে জামায়াত কি আদৌ আন্তরিক, নাকি অন্য কোন উদ্দেশে দর কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে এটিকে ব্যাবহার করছে দলটি? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ কেননা এ পর্যন্ত দলটি নিম্নকক্ষে পি আর-এর সুবিধাগুলো নিয়েই কেবল বলে যাচ্ছে, বিশেষজ্ঞরা এবিষয়ে যে আশঙ্কার কথা বলছেন সেগুলোর কোনরকম জবাব না দিয়েই।
এখানে লক্ষণীয় যে সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রাথমিক পর্যায়ে নিম্ন কক্ষে পি আর-কে বিবেচনায় নিলেও পরবর্তীতে এটিকে বাদ দিয়ে দেয়। কারন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, বিশেষত যেখানে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি এবং রাজনৈতিক দলগুলোও একে অপরের সাথে আপোষ-রফায় অনিচ্ছুক থাকে সেখানে এই পদ্ধতিতে ঘন ঘন সরকার পতন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংকটের জন্ম দেয়।
নেপাল, যেখানে মিশ্র পি আর পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেখানে ১০ বছরে (২০০৮-২০১৮) ৯ বার সরকার পরিবর্তন হয়েছে। ২০১০ এর নির্বাচনের পরে বেলজিয়ামে (যেখানে পি আর পদ্ধতি চালু আছে) ৫৪১ দিন লেগেছিল সরকার গঠন করতে। তাই এখনি বাংলাদেশে এধরনের অবস্থা কাম্য নয়। এমন আশংকাও রয়েছে, যেই ধরনের পি আর পদ্ধতিই (আবদ্ধ বা উম্মুক্ত) প্রবর্তন করা হোক না কেন, জনগণ সেখানে কার্যকর এবং দক্ষভাবে নিজস্ব (সংসদীয়) আসনের সেবা থেকে বঞ্ছিত হবে।
এখনো পর্যন্ত উল্লেখিত আশংকার ক্ষেত্রে জামায়াতের কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি এবং নিম্নকক্ষে যে নির্দিষ্ট পদ্ধতির পি আর তারা দাবি করছেন, সেই পদ্ধতির ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যাও তারা দেননি। জামায়াতের দাবীকৃত পি আর পদ্ধতি (party list PR) ছাড়াও আরও নানারকমের পদ্ধতি (largest remainder, Mixed Member PR, variants of party list, Single Transferrable Vote) রয়েছে এবং সেই পদ্ধতিগুলোতে জামায়াতের দাবীকৃত পদ্ধতির বেশকিছু সমস্যার সমাধানও রয়েছে।
জামায়াত কি ব্যাখ্যা করেছে যে তারা সবগুলো পদ্ধতি বিবেচনায় নিয়েছে, কেন তারা সেগুলোকে বাদ দিয়েছে, কেনই বা তারা তাদের দাবীকৃত পদ্ধতি বেঁছে নিয়েছে? সঠিকভাবে গবেষণা না করে, পরিণতি অনুধাবন না করে যদি তারা এই দাবিতে অনড় থাকে তাহলে যে জটিলতা তৈরি হবে তা দলটির সামর্থ্য এবং অভিপ্রায় নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করবে। এক্ষণে এমন একটি দল যে মূল রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে, নিজের অবস্থানকে অস্পষ্ট রাখে, আমরা কেন সেই দলকে বিবেচনায় নিবো, কেনই বা আস্থা রাখবো যে দলটির শাসন করার সক্ষমতা রয়েছে।
তৃতীয়ত, জামায়াত সম্প্রতি এমন একটি অদ্ভুত “অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক আদেশ” এর প্রস্তাবনা নিয়ে এসেছে যা প্রকারান্তরে দলটির গণতন্ত্র বিষয়ে অনুধাবন এবং গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধতাকে গভীর প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
জামায়াত প্রস্তাব করেছে কোন রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই “অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক আদেশ” (যেখানে জুলাই সনদ অন্তর্ভুক্ত থাকবে) এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে এবং জুলাই সনদের কোন ধারার বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো যাবেনা। যদি এটা করা হয়, তাহলে সেটাকে বিদ্রোহ বা বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। এটা কিভাবে গণতান্ত্রিক হতে পারে? এটা কেবল মত প্রকাশের স্বাধীনতার লঙ্ঘনই নয়, এভাবে দলগুলোকে নিঃশর্তভাবে কোন আদেশ মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া আখেরে ভোটারদের অধিকার খর্ব করারি নামান্তর, বিশেষত যাদের জুলাই সনদের নির্দিষ্ট ধারার ক্ষেত্রে দ্বিমত থাকবে।
এটি রাজনৈতিক সমস্যাকে আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধানের একটি প্রচেষ্টার উদাহরণ যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করেনা। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক, যেটির অপব্যাবহার করে বিগত সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।
যেহেতু রাজনৈতিকক্ষেত্র জনাকীর্ণ ও নানা বয়ানে পূর্ণ হচ্ছে, আমাদেরকে সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে কেউ যেন “ফ্রি পাস” না পায়।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন, জি এম সোহরাওয়ারদী




