“বাবা, আমায় মাফ করে দিস”
আকরাম হুসাইন সিএফ
২০২২ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর টিএসসিতে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ আয়োজিত শহিদ আবরার ফাহাদ স্মরণসভা থেকে আমি ও আমার সহযোদ্ধারা গ্রেফতার হই। তার ঠিক সাত দিন আগে, ৩০ সেপ্টেম্বর আমার বিয়ে হয়েছিল—যদিও আকদ হয়েছিল আরও দুই মাস আগে।
এর আগেও জেলযাপনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল ২০২১ সালে। মোদিবিরোধী আন্দোলনের পর গ্রেফতার হয়ে জেলে কাটিয়েছিলাম প্রায় ছয় মাস। তবে দ্বিতীয়বার জেলে আসার অভিজ্ঞতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। জীবনটা হঠাৎ করেই যেন এলোমেলো হয়ে গেল। গ্রেফতারের আগে রডের আঘাতে আমার বাম পায়ের হাড় ভেঙে যায়। ব্যথায় তখন হাঁটাও অসম্ভব হয়ে পড়ে। জেলে থাকাকালীন এই সময়টা অসহ্য হয়ে উঠেছিল। মুক্তির পরও প্রায় ছয় মাস আমাকে বিছানায় কাটাতে হয়েছে—এক একটা দিন কেটেছে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্য দিয়ে।
আমি জেলে থাকাকালীন আমার স্ত্রী প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেই সময়েই জানতে পারি, সে সন্তানসম্ভবা। কিন্তু ভাগ্য যেন তখনও আমাদের সহায় হয়নি। প্রেগনেন্সির মাত্র দুই মাসের মাথায়, দুশ্চিন্তা আর একা লড়াইয়ের চাপে সে মিসকারেজ করে ফেলে।
আইন অনুযায়ী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বামীর স্বাক্ষর ছাড়া কোনো অপারেশন করতে চায়নি। আমার পরিবার তখন কুমিল্লা থেকে নোয়াখালী—হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরছে। আমি জেলে বসে খবরগুলো টুকরো টুকরোভাবে শুনতাম, কিন্তু কিছুই করতে পারতাম না। কোনো কোনো ডাক্তার ঝামেলায় জড়ানোর ভয়ে অপারেশন করতে রাজি হননি।
বাবা তখন ঢাকায় আমার মামলার কাজে ব্যস্ত। মা, বোন আর শাশুড়ি—যারা কখনো থানার গেটও পেরোননি—তারা হাসপাতালের বারান্দায় সারাদিন কাটাতেন। অবশেষে আমার শাশুড়ি ঝুঁকি নিয়ে সেই মিসকারেজের ইতি টানেন।
ছবিতে, পরিবারের প্রয়াত একজন সদস্যের সাথে আকরাম হুসাইন
যারা জানেন, তারা বুঝবেন—তিন মাসের মাথায় ওষুধের সাহায্যে মিসকারেজ কতটা ভয়ংকর যন্ত্রণা। তবু পরিবার আমাকে কিছু জানায়নি। আমি জেলে থাকতে বাবা প্রায়ই এসে বলতেন, “বাবা, আমায় মাফ করে দিস।” আমি কাঁদতাম, কিন্তু বুঝতাম না কেন তিনি এমন বলছেন।
বের হয়ে বাড়ি ফিরে সব জানতে পারি। জানতে পারি, আমার সেই অনাগত সন্তান আর নেই। তারও দুই মাস পর চলে গেলেন আমার বাবা—যিনি হয়তো বেঁচে থাকলে একবার হলেও আমার সন্তানকে কোলে নিতে পারতেন।
এই এক মিথ্যা মামলা আমাদের শুধু কারাগারে পাঠায়নি—আমাদের পরিবার থেকে কেড়ে নিয়েছে হাসি, আশা, এমনকি নতুন একটি প্রাণের উপস্থিতিও।
সে দিনগুলোর কথা মনে হলে নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে যায়। আনমনে ভাবি—যদি আমি জেলে না যেতাম, হয়তো বাবা অন্তত একবার আমার সন্তানকে দেখে যেতে পারতেন। সারা জীবন আমি এই কষ্ট বয়ে বেড়াবো।




