ডাকসু নির্বাচন: গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নেতৃত্ব, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা
সিনথিয়া পারভীন মল্লিক, পরিবেশ প্রকৌশলী
দীর্ঘ দেড় দশকের নির্বাচনহীনতায় আমাদের নাগরিক জীবনের আগ্রহ-উত্তেজনার বিষয় হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্প সমিতির নির্বাচন। ২০২২-এ অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে চলচ্চিত্র অভিনেতা জায়েদ খান বনাম অভিনেত্রী নিপুণ আক্তারের পারস্পরিক ব্যাপক কাদা-ছোড়াছুড়ি ও মামলা-হামলার ভেতর দিয়ে টান টান উত্তেজনা বয়ে যায় আমাদের জীবনে। বলা বাহুল্য উভয় পক্ষই ছিলেন তৎকালীন সরকারের বিভিন্ন মহলের আশীর্বাদপুষ্ট, কেবল আশীর্বাদ পাবার ইঁদুর-দৌড়ে হয়তো একজন আরেকজনের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে পড়ায় এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।
যাকগে, তখনকার সেই দ্বন্দ্ব আজকের আলোচনার বিষয় নয়, সেই নির্বাচনের প্রায় তিন বছর আগে এই দেশে এসেছিল আরেকটি নির্বাচন - সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন। নানা রকম ছলাকলায় আটকে দিতে চাওয়া সেই নির্বাচন অবশেষে অনুষ্ঠিত হয় উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে। কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) এবং সমাজসেবা সম্পাদক পদ ছাড়া সব ক’টি পদে জয়ী হয় ছাত্রলীগের সরাসরি কিংবা ছায়া প্যানেলের (পরিষদের) প্রার্থীরা। সকাল-বিকাল গেস্টরুম সংস্কৃতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অপমান-অত্যাচার করা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন নাকি পান ইতিহাসের সর্বোচ্চ ভোট। হায় সেলুকাস!
নির্বাচনে জয়ী না হলেও, লীগের রক্তচক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে যারা প্রার্থী হবার সাহস দেখিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ’২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের। শুধু ’২৪-ই নয়, স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ সব আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন বিভিন্ন সময়ের ডাকসুর নেতৃত্ব। কেবল ডাকসুই নয়, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সংসদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের দেখা গেছে জাতীয় আন্দোলনগুলোয় সামনের দিকের নেতৃত্বে। আর একারণেই কিনা কে জানে, আধিপত্যের রাজনীতিতে ক্ষমতাশীল পক্ষ বরাবরই চেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সংসদের নির্বাচনকে আটকে দিতে, নয়তো অসদুপায়ে নিজেদের পক্ষে ফল প্রভাবিত করতে। ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের প্রতিপক্ষ প্রস্তুতি নিক এই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে - এ হেন উপায় কী আর ভালো লাগে ক্ষমতাসীনদের!
’২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ গণতান্ত্রিক পদযাত্রায় এগিয়ে যাবে এটাই ছিল একটি স্বাভাবিক চাওয়া। তারই সূত্র ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দাবি উঠতে থাকে কেন্দ্রীয় সংসদ নির্বাচনের। বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের দেয়া রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাবনাগুলোতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) মোটাদাগে রাজি হতে পারেনি। অথচ সেই একই দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের আগে ৩৭৭ দফা সংস্কারের প্রস্তাবনা নিয়ে আসে। অন্যান্য ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক পক্ষ থেকে ছাত্রদলের এই প্রস্তাবনাকে ডাকসু নির্বাচন পেছানোর অপকৌশল হিসেবে দেখা হয়। জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন যেমন সাধারণ নাগরিকের মতামত যাচাই করার উদ্যোগ না নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথেই আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকে, একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ডাকসু নির্বাচন এবং সংস্কার নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন ক্রিয়াশীল ছাত্র রাজনীতি পক্ষগুলোর সাথে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সাথে আলোচনা করবার ও তাঁদের মত নেবার সময় কোথায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের! যাক, সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ঘোষণা আসে ডাকসু নির্বাচনের। রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘোষিত হয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দিনকাল।
আর কিছুদিন পরেই ডাকসু নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী আবহ ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে, অনলাইন-অফলাইনে। নতুন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চর্চা হিসেবে গণমাধ্যমগুলোয় আয়োজিত হচ্ছে উন্মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠান যেখানে বিভিন্ন পরিষদের প্রার্থীদের এক মঞ্চে রেখে সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে পারস্পরিক যুক্তি-তর্কের। ভোটাররা সুযোগ পাচ্ছেন প্রার্থীদেরকে সরাসরি প্রশ্ন করবার। এধরনের অনুষ্ঠানগুলো সাধুবাদ পাবার মত এবং এই ধারা জাতীয় নির্বাচনেও ধরে রাখতে পারলে জনগণ প্রার্থীদের একটু বাজিয়ে নেবার সুযোগ পাবে।
এবারের ডাকসু নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে সম্ভবত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস), মেঘমল্লার-ইমি নেতৃত্বাধীন বামপন্থী, এবং উমামা ফাতেমার নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র পরিষদের মাঝে। যে কোনো নির্বাচনের মতই নিজেদের ইশতেহার তুলে ধরার পাশাপাশি এখানেও চলছে বিপক্ষ প্রার্থীর ছিদ্রান্বেষণ। উন্মুক্ত বিতর্কগুলোয় উঠে আসছে নারীদের অনলাইনে হেনস্থা করায় কোন দলের কর্মীদের কেমন ভূমিকা কিংবা হেনস্থার প্রতিবাদে কে কত সোচ্চার তা। প্রশ্ন আসছে আদর্শিক রাজনীতিতে জড়িত প্রার্থী নির্বাচিত হলে বিপরীত আদর্শের অনুসারী শিক্ষার্থীদের প্রতি কতটা সহানুভূতিসম্পন্ন হবেন তা নিয়ে। শিক্ষার্থীরা আরো জানতে চান, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জয়ী দলের ছাত্র সংগঠন ডাকসুতে জয়ী হলে ভবিষ্যতে তারা মূল দলের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাজ করতে পারবেন কিনা। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে কোন কোন প্রার্থী ছাত্রকল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচীর উদ্যোগ নিয়েছেন, আবার বড় ছাত্র সংগঠনগুলো নিজস্ব অর্থায়নে পানির ফিল্টার দিয়েছে আবাসিক হলে। আলোচনায় এসেছে ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য কী হওয়া উচিতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানে নিজস্ব তহবিল ব্যবহার করা নাকি সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের দাবিদাওয়া, যেমন হলে পানির পর্যাপ্ত যোগান, আবাসন সমস্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় জলাবদ্ধতা, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, এসব নিয়ে প্রশাসনের কাছে দাবি উত্থাপন এবং তা গণতান্ত্রিক উপায়ে আদায় করে নেয়া।
ডাকসু নির্বাচনে ভিপি এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ’২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারির নেতা আব্দুল কাদের ও আবু বাকের মজুমদার বাগছাসের পরিষদ থেকে। প্রসঙ্গতঃ আব্দুল কাদের ঐতিহাসিক নয় দফার নায়ক হিসেবে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন ’২৪ এর জুলাইয়ে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় নেতা-নেত্রীকে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর যে কয়জন নেতার ভিডিও নির্দেশের জন্য জনগণ উন্মুখ হয়ে থাকত তাঁদের মাঝে একজন ছিলেন আব্দুল কাদের। ভিডিও বার্তা আরো আসত মাহীন সরকারের কাছ থেকে, যিনি সম্প্রতি তার প্রার্থিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করেছেন এবং তাঁর সহযোদ্ধা আবু বাকেরের জন্য জিএস পদে ভোট চেয়েছেন তাঁর সমর্থকদের কাছে। আবু বাকের মজুমদার ছিলেন ডিবি অফিসের সেই আটক ছয় নেতা-নেত্রীদের একজন। কুখ্যাত ডিবি হারুনের অফিসের নির্মম অত্যাচারের কালশিটে দাগ বয়ে নিয়েও মুক্ত হয়েই আবার ফিরে এসেছিলেন আন্দোলনের ময়দানে! এই পরিষদের আরেক নেত্রী আশরেফা খাতুনও ছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক, নেতৃত্ব দিয়েছেন মিছিলে-শ্লোগানে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আরেক পরিচিত মুখ, তৎকালীন সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা নির্বাচন করছেন ভিপি পদে। অভ্যুত্থানের পরেও উমামা সরব থেকেছেন সব কয়টি রাজনৈতিক ইস্যুতে। নির্বাচনে আরো আছেন মেঘমল্লার বসু, যিনি অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রপাগাণ্ডামূলক গণমাধ্যমে মহা-উত্তেজিত সহ আলোচক এবং উপস্থাপককে দৃঢ় কণ্ঠে মাওলানা ভাসানীর উক্তিটি মনে করিয়ে দিয়ে এসেছেন - “পিন্ডীর জিঞ্জির ছিন্ন করেছি দিল্লীর গোলামি করার জন্য নয়।” এই তরুণ ছাত্রনেতারা শুধু গণঅভ্যুত্থানই নয়, তারও আগে, যখন শেখ হাসিনার শাসনামলে বাকস্বাধীনতার বিন্দুমাত্র লেশ ছিল না, তখনও সোচ্চার থেকেছেন ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, সরব থেকেছেন আন্দোলনে মাঠে-ময়দানে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধাচরণে। ছাত্রদলের ভিপি পদপ্রার্থী আদিবুল ইসলাম খান পরিবারের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য। মেঘমল্লার, উমামা, কিংবা কাদের-বাকের-আশরেফাদের গত কয়েক বছরের আন্দোলন-মিছিল-শ্লোগানের ছবি ও ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় যে তারা আদর্শিকভাবে ভিন্ন রাজনীতির অনুসারী হলেও শেখ হাসিনার বিরোধিতায় দিনের পর দিন লড়াই করেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে। কারাবরণ করেছিলেন আব্দুল কাদের, মেঘমল্লারের চোখে লোহার রড দিয়ে আঘাত করেছিল ছাত্রলীগ, মারধরের স্বীকার হয়েছিলেন তাঁদের সহযোদ্ধারা। কিন্তু কারাবরণ, আহত চোখ, কিংবা ছাত্রলীগের দমন-পীড়ন থামাতে পারেনি এই তরুণ নেতৃত্বকে।
শিবির নেতা ভিপি পদপ্রার্থী সাদিক কায়েমও গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, নয় দফাকে গণমাধ্যমের কাছে পৌঁছে দিয়ে এবং আন্দোলনের নেতৃত্বের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে। তবে তার বিপক্ষ প্রার্থীদের অভিযোগ যে তারা যখন সব ঝুঁকি উপেক্ষা করে একটি অত্যন্ত দমবন্ধ পরিবেশেও হাসিনা-বিরোধী প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছেন, আন্দোলন করেছেন, সাদিক কায়েম তখন ছাত্রলীগের সাথে আনন্দ-উল্লাসে মেতেছেন। যদিও সাদিক কায়েম ও তার পরিষদের জিএস পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদ অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগের সাথে কোনো পূর্বসম্পৃক্ততার, এই বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে উন্মুক্ত বিতর্ক অনুষ্ঠানগুলোয়। প্রসঙ্গতঃ এস এম ফরহাদের ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে তাঁর প্রার্থিতার বৈধতাকে প্রশ্ন করে রিট দায়ের করেন ডাকসুর ‘অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪’ প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনবিষয়ক সম্পাদক প্রার্থী বি এম ফাহমিদা আলম। প্রথমে ডাকসু স্থগিত ও পরে চেম্বার আদালতের মাধ্যমে পুনর্বহালের মধ্য দিয়ে এক টানটান উত্তেজনার নিরসন ঘটে।
শিবির নেতাদের আরো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের অবস্থান নিয়ে। শিবিরের নিজস্ব প্রকাশনী ছাত্র সংবাদে এবছরের শুরুতে একটি নিবন্ধে বলা হয় যে ১৯৭১-এ এদেশের মুসলমানেরা অনেকে না বুঝে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে ব্যর্থতা ও অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। শিবিরের পরিষদ থেকে কার্যনির্বাহী সদস্য প্রার্থী জয়েন উদ্দিন সরকার তন্ময়ের একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে ফ্লাইট হাইজ্যাকার ও একই ফ্লাইটে অবস্থিত পাকিস্তানি শিক্ষানবীশ পাইলট রশীদ মিনহাজকে শহীদ বলে ভূষিত করেন। একই পরিষদের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক প্রার্থী ফাতিমা তাসনিম জুমাকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শিবিরের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন যে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার জামায়াতের নেতাদেরকে রাজাকার হিসেবে “পোর্ট্রে” করা হচ্ছে। যদিও টিএসসির যেই ঘটনার উল্লেখ তিনি করেছেন, সেখানে যাঁদের ছবি ছিল তাঁদের মাঝে অন্তত একজন (গোলাম আজম) স্বঘোষিত রাজাকার ছিলেন!
অন্য যেকোন নির্বাচনের মতই এই নির্বাচনেও চলছে নানা রকম কূটকৌশল। অভিযোগ আছে নির্বাচনী আচরণবিধিকে পাশ কাটাতে প্রার্থীর বন্ধুর নামে আবাসিক হলে ভুঁড়ি-ভোজন আয়োজনের। পুরান ঢাকার রেঁস্তোরায় নাকি প্রতিরাতে চলছে শত শত শিক্ষার্থীদের বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা। স্থানীয় নেতাকর্মীরা সেই কোন এক জেলা-উপজেলা থেকে যোগাযোগ করছেন তাঁদের এলাকা থেকে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, তাঁদের দলের প্রার্থীকে ভোটটা দিয়ে দেবার জন্য। যদিও ভাইরাল হওয়া এমন এক নেতাকে বহিষ্কার করেছে ছাত্রদল, ভাইরাল হননি এমন কতজন নেতাকর্মী এরকম কাজ করে যাচ্ছেন তা কে বলবে!
স্বাধীনতা-পরবর্তী গত ৫৪ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে কেবল সাত বার! ১৯৭৩-এ অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ভোট গণনার সময়ে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তৎকালীন জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরবর্তীতে ১৯৭৯ ও ১৯৮০-তে দুইবারের নির্বাচিত ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না এ প্রসঙ্গে বলেন যে মুজিববাদী ছাত্রলীগ সকালে জাল ভোট ও সন্ধ্যায় ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত ছিল। ডাকসু নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়া কিংবা প্রভাবিত করবার এরকম হীন প্রচেষ্টা বারবার দেখা যায় স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে। প্রসঙ্গতঃ এরশাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পর প্রথমবারের মত ’৯০-এ বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ডাকসুতে জয়ী হয় ছাত্রদল। নির্বাচনে জয়ী হয়েই বিভিন্ন কৌশলে ডাকসু নির্বাচনে বাধা দিতে থাকেন তৎকালীন ছাত্রদলের নেতারা, তাঁদের মূল দল বিএনপির স্বার্থে। এবারের নির্বাচনে ছাত্রদলের পরিষদ ’৯০-এর সেই সোনালী সময়কে ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, জয়ী হয়ে তৎকালীন ছাত্রদল যেমন নানা রকম কূটকৌশলে ডাকসু নির্বাচন আটকে দিয়েছে ক্ষমতাসীন মূল দল বিএনপির স্বার্থে, এবারে নির্বাচিত হলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে ডাকসুকে কি আবারো ঠেলে দেবে অচলায়তনের দিকে?
ডাকসু থেকে প্রতিবাদী ছাত্রনেতা হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে, পরবর্তীতে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করবার বদলে সময়ের পরিক্রমায় নিজেরাই ক্ষমতার রুটি-হালুয়ার ভাগ পেতে আদর্শকে বিসর্জন দিয়েছেন এমন উদাহরণ কম নয়। এই যেমন ১৯৬৩-এর ভিপি-জিএস ছিলেন রাশেদ খান মেনন ও মতিয়া চৌধুরী। মেনন-মতিয়ারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েও দেড় দশক ধরে একটা অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশ হয়েছেন, ভূমিকা পালন করেছেন স্বৈরাচারী সরকারের। আবার ১৯৭৯ ও ১৯৮০-তে দুইবারের নির্বাচিত জিএস ও পরবর্তীতে ১৯৮২-তে নির্বাচিত ভিপি আখতারুজ্জামান পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে গল্প শুনিয়েছেন “চা-চপ-সিঙ্গাড়া”-এর! দীর্ঘ সময় রাজত্ব করলেও এদেশের জনগণ একদিন ঠিকই তাঁদের আঁছড়ে ফেলেছে।
এবারের নির্বাচনে যে-ই জয়ী হোন না কেন, তাঁরা যেন পরবর্তীতে গণমানুষের রাজনীতিটা উপেক্ষা না করেন এটাই কামনা থাকল। আর যারা জয়ী হবেন না, তাঁরা যেন হারজিতকে পেছনে ফেলে, তাঁদের দীর্ঘসময়ের রাজনৈতিক অবস্থান-সংগ্রাম ধরে রাখেন ও ছাত্রকল্যাণমুখী কার্যক্রম চালিয়ে নিয়ে যান এই প্রত্যাশা থাকল। তা নইলে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে জনগণ দ্বিতীয়বার ভাববে না, সাম্প্রতিক ইতিহাসই তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন।