এক অদ্ভুত প্রাতিষ্ঠানিক আত্মঘাৎ
ড. নাবিলা ইদ্রিস
পিএইচডিতে প্রফেসররা শিখিয়েছিলেন, “একজন ভালো গবেষক ‘কী হয়েছিল’ জানতে চাওয়ার ঊর্ধ্বে জানতে চায় ‘কেন হয়েছিল’।” মনে ধরেছিল কথাটা, যদিও পরবর্তীতে এই ‘কেন’-এর বিশ্লেষণ রপ্ত করতে গিয়ে যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছি!
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে। অতএব গুম কমিশনে যদিও আমাদের কাজ মূলত ‘কী’ কেন্দ্রিক, মনের অগোচরে ‘কেন’-এর ভূত আমাকে ছাড়ে না।
অনেক ‘কেন’-এর মাঝে আজকাল যেই ‘কেন’-টা আমাকে বেশ ভাবায়, সেটা হলো—গুমের জন্য অভিযুক্ত অফিসারদের ব্যক্তিগত অপরাধ কেন তাদের প্রতিষ্ঠান স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে? কাজটা এত আত্মঘাতী যে আমরা এর কোনো আগামাথা বুঝি না।
ব্যাপারটা এরকম—ধরুন আমি বাংলালিংকে চাকরি করি, পরে গ্রামীণফোনে গেলাম। সেখানে ভালো মতো চুরি করে, ক’দিন পর বাংলালিংকে ফিরে এলাম। এদিকে আমার গ্রামীণফোনের কুকীর্তি ফাঁস হওয়ায়, পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করতে হাজির হলো বাংলালিংকে। বাংলালিংক কি আমার গ্রামীণফোনের অপরাধের দায় নেবে? বাংলালিংকের কোনো কর্মকর্তা কি বলবে, “চল, তোমার গ্রামীণফোনের অপরাধ লুকাতে সহযোগিতা করে আমি আমার ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে ফেলি”? উহু, কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা বলবে, “ওখানে যা করেছ, সেটা তোমার সমস্যা। আমাকে বা আমার প্রতিষ্ঠানকে তোমার অপরাধে জড়িও না।”
কিন্তু অদ্ভুতভাবে গুম-খুনের বিচারের বিষয়ে আমরা ঠিক এই অস্বাভাবিক ঘটনাটাই দেখছি। প্রমাণ নষ্ট করে, দায় এড়িয়ে সহযোগিতা করে, পালাতে দিয়ে, “হেফাজতে আছে কিন্তু গ্রেফতার নয়”—এমন কথা বলে—একটা নতুন অফিসার শ্রেণি (যারা বাংলালিংকের মতোই মূলত নির্দোষ) অন্যদের ব্যক্তিগত অপরাধ নিজের ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে।
ভালো গবেষক হওয়ার সেই আদি খায়েশের তাড়নায় আমি বোঝার চেষ্টা করছি, কেন এমন আত্মঘাতী কাজ তারা করছেন। কারণ এটা তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে এসব অফিসারদের এই সদ্যসৃষ্ট আমলনামা নিয়েই অচিরেই তাদের পেশাগত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা টান দেবে। তাই আইনি হোক বা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে—খুব শিগগিরই তারা একদম অকারণে এর মাশুল দেবেন!
তাহলে কৌতূহল জাগে না যে কেন তারা এমন করছেন? আমার তো জাগে।
অনেক কারণ মাথায় আসে, তবে আজ একটা শেয়ার করি। আমার কাছে মনে হয়েছে—ইনারা একই সামাজিক শ্রেণির হওয়ায়, অভিযুক্ত অফিসারদের মাঝে নিজেদের দেখতে পান, সম্পর্ক খুঁজে পান। তাঁরা অনুভব করেন, “ইনার সঙ্গে আমি অমুক জায়গায় চাকরি করেছি; আমার স্ত্রী তো ভাবীর বন্ধু। যদি আমার পোস্টিং হতো র্যাব ইন্টেলিজেন্সে বা ডিজিএফআই-এ, হয়তো আমিও এরকম করতাম। অতএব গুম-খুনের বিচার বাধাগ্রস্ত করে আমি একরকম পুণ্যের কাজই করছি; আসলে আমি আমার নিজের বিকল্প সত্ত্বাকেই বাঁচাচ্ছি!”
আমার মনে হয়েছে এই কর্মকর্তারা এখানে দুইটা বড় বিশ্লেষণগত ভুল করছেন।
১) তাঁরা ভাবছেন, তারাও ওই পোস্টিংয়ে থাকলে এমন অপরাধ করতেন। এটা আসলে সত্য নয়। আমরা যথেষ্ট প্রমাণ পাই যে সৎ অফিসাররা এসব অপরাধ থেকে দূরে থেকেছেন। এমনকি আওয়ামীপন্থী অফিসারও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুম-খুনে অংশ নিতে রাজি হননি—এমন একাধিক প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। অর্থাৎ যারা গুম-খুন করেছে, তারা সচেতনভাবেই বেছে নিয়েছে। পোস্টিং-এর পরদিন রাতারাতি সবাই খুনি হয়ে যায়—এটা নিছক প্রচারণা ছাড়া কিছু নয়।
২) সামাজিক সম্পর্কের অভাবে তাঁরা ভিকটিমের সঙ্গে সহমর্মিতা গড়ে তুলতে পারেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁর স্ত্রী কেবল ভাবীর বন্ধু, ভিকটিমের “আমি কি বিধবা না সধবা?” সেই স্ত্রীর বন্ধু নন।
এর মানে, যদি আমরা কেবল নিচু পর্যায়ের অভিযুক্তদের ধরতাম, প্রতিষ্ঠান কখনও এই আত্মঘাতী দায় নিজের ঘাড়ে নিত না
কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কি অফিসের দারোয়ানের জন্য নিজের ক্যারিয়ার বিসর্জন দেবেন? উহু!
এই বিশ্লেষণগত ভুলের কারণেই তাঁরা সামনে যে বিশাল ব্যক্তিগত বিপদ আসছে—যখন তাঁদের বর্তমান কার্যকলাপের বিবেচনায় নির্বিচারে তাঁদের ক্যারিয়ার (অথবা জীবন) আটকে যাবে—সেই সম্ভাবনাটা তাঁরা উপেক্ষা করছেন।
সমাধান কী? আসলে আমাদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটে। যখন ৬-৭ ঘণ্টা ধরে একজন অভিযুক্তের সাক্ষাৎকার নিই, তখন খানিকটা হলেও তাদের চিনে ফেলার সুযোগ পাই। সে সময় সৎভাবে অনেক চিন্তা মাথায় আসে। ভাবি, “হুঁ, ওই সময়ে লোকটা অনেক অপরাধই করেছে। কিন্তু আজকের অবস্থা করুণ—স্ত্রীর সঙ্গে অশান্তি, সন্তানের পড়াশোনা লাটে উঠেছে।” করুণা হয়।
এসব ক্ষেত্রে আমি স্মরণ করি নৌকায় চোখ বেঁধে শোয়ানো ভিকটিমের অন্তিম মুহূর্তের কথা। কারণ কাজের সূত্রে এই ভিকটিমদের—যাদের কখনও সামনাসামনি দেখিনি, হয়তো পরকালে দেখব—তাদেরও চিনে ফেলেছি।
জানেন, আমি একাধিক অফিসারের সঙ্গে যাচাই করেছি যে, মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ভিকটিমরা কি লড়াই করেছিল? হাতে গোনা কয়েকটি উদাহরণ ছাড়া কেউই চেষ্টা করেনি পালাতে; অধিকাংশই করেনি। একজন বলেছিলেন, “না, ওরা তো একদম নিঃশেষ তখন। জানে যে মারা যাবে। খুব নির্জীব।”
আমি তা নিতে পারি না, ভাই। আমি এমন একজন মানুষের ট্র্যাজেডি নিতে পারি না, যে নিজের মৃত্যুকে মেনে নিয়েছে। আমি পারি না। একদম পারি না।
আপনিও মেনে নেবেন না। এই ঘৃণ্য অপরাধের দায়মুক্তি দিতে গিয়ে আপনার জান-মাল, ক্যারিয়ার, পরিবার এবং সর্বোপরি, বিবেক বিসর্জন দেওয়া সাজে না, ভাই। সত্যিই সাজে না।




