গণতন্ত্রের নতুন অধ্যায় গণভোটে
মোঃ সোহেল রানা
বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি আন্দোলন ছিল না, এটি ছিল জনগণের আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। আজ সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় যখন গণভোটের আলোচনা সামনে এসেছে, তখন প্রশ্নটি স্পষ্ট—এই দেশ কে পরিচালনা করবে? ক্ষমতার আসনে বসা গুটিকয়েক মানুষ, না কি সেই কোটি জনতা যারা রাস্তায় নেমে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিল?
গণভোটের সুপারিশ নিয়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছে, তা কেবল একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই নয়। এটি বরং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতা, যেখানে জনগণের মতামত হবে বাংলাদেশ ২.০-এর সবচেয়ে শক্তিশালী একটি হাতিয়ার।
দশকের পর দশক ধরে আমরা শুনে আসছি, “জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।” কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন কোথায়?
রাজনৈতিক দলগুলো বিগত ৫৪ বছরে ক্ষমতা ভোগের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল, এবং তার কিছুটা এখনো পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাদের লক্ষ্য জনগণের সেবা নয়, বরং প্রভাব, প্রতিপত্তি আর সম্পত্তি বিস্তার।
কিন্তু সেই পুরনো প্রথা জিইয়ে রাখার জন্য মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে নাস্তায় নামেনি। মানুষ যে শুভ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছে, এবার সময় এসেছে সেই পরিবর্তনের। একটি গণতান্ত্রিক পরিবর্তন, যেখানে জনগণ নিজের অধিকার আদায়ে হতে হবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এবং এই পরিবর্তনের সূচনা হোক গণভোট দিয়ে, যেখানে মানুষ সত্যিকার অর্থে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে। এটিই হবে ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী ঐতিহাসিক অধ্যায়।
চলুন, প্রথমেই জেনে নেই, গণভোট আসলে কী।
গণভোট (Referendum) হলো একটি জনমত যাচাই প্রক্রিয়া, যেখানে দেশের জনগণ সরাসরি ভোটের মাধ্যমে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বা সাংবিধানিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়।
এটা সাধারণ নির্বাচনের মতো নয়, কারণ নির্বাচনে আমরা কোনো ব্যক্তি বা দলকে বেছে নিই; কিন্তু গণভোটে আমরা ভোট দিই একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের “হ্যাঁ” বা “না” উত্তরে।
উদাহরণস্বরূপ,
একটি দেশের সংবিধান পরিবর্তন করা হবে কি না, একটি অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা দেওয়া হবে কি না, কোনো বড় নীতি বা রাজনৈতিক কাঠামো চালু রাখা হবে কি না—এই ধরনের সিদ্ধান্তই সাধারণত গণভোটের মাধ্যমে নেওয়া হয়।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, গণভোট কেন প্রয়োজন হয়?
গণভোটের মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের হাতে সরাসরি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। বেশিরভাগ দেশে রাজনীতিবিদরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু সব সিদ্ধান্তই যে জনগণের আসল মতের প্রতিফলন, তা কিন্তু নয়। তাই গণভোট হচ্ছে এমন একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, যেখানে জনগণ নিজেরাই বলে দেন, তারা কী চান এবং কোন পথে দেশ চলবে।
অতীতে বাংলাদেশে তিনবার গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল।
৩০ মে ১৯৭৭ সালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের জনসমর্থন ও বৈধতা যাচাই করা।
দ্বিতীয় গণভোট ২১ মার্চ ১৯৮৫ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক শাসনের জনসমর্থন নিশ্চিত ও ক্ষমতা বৈধ করার জন্য আয়োজন করেছিলেন।
তৃতীয় গণভোট হয়েছিল ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ সালে; আয়োজন করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি থেকে সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া।
ঠিক তেমনি বর্তমান সময়ে গণভোট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা যাচাইসহ সংবিধান সংস্কারের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে, যা ভবিষ্যতে কোনো সরকার কিংবা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
প্রশ্ন হচ্ছে—এই প্রক্রিয়াটি কতটা স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে? সেই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত রইবে বাংলাদেশ ২.০-এর ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত।
এটি সফল করতে হলে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোকে একই সারিতে আসতে হবে। গণভোটের প্রশ্নে একমত হয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি ঘোষণা করতে হবে—কখন, কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় গণভোট অনুষ্ঠিত হবে তা জনগণকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। গণভোটে যদি জনগণ সংস্কারের পক্ষে সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলে “নোট অব ডিসেন্ট” কার্যকর থাকবে না, সেটি তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত বলে বিবেচিত হবে।
২৪-এর গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা ইতিহাসে বারবার ফিরে আসবে। এটির সঙ্গে জড়াবে সফলতা ও ব্যর্থতার গল্প, ত্যাগ ও প্রত্যাশার স্মৃতি। আর যদি সত্যিকারের গণভোটের মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্য পূর্ণতা পায়, যে উদ্দেশ্যে জনগণ রাস্তায় নেমেছিল, যে স্বপ্নে মানুষ প্রাণ দিয়েছিল—তাহলে নিঃসন্দেহে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নাম ইতিহাসে ইতিবাচকভাবে উচ্চারিত হবে বারবার।
এই প্রেক্ষাপটে ধন্যবাদ জানাই ঐক্যমত কমিশনকে, যারা বাংলাদেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে একই টেবিলে এনে তাদের মতামত শুনে একটি ঐক্যবদ্ধ খসড়া প্রস্তাব তৈরি করতে পেরেছেন। এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে জাতীয় ঐক্যের পথে একটি ইতিবাচক ও ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
রাজনীতিবিদদের মনে রাখা উচিত—
রাজনীতি মানে দল নয়, জনগণ।
গণভোট মানে ক্ষমতা নয়, জনগণের অংশগ্রহণ।
শেষ প্রশ্ন শুধু একটাই—
ক্ষমতা না জনতা?
উত্তর একটাই—
জনতা, জনতা, এবং জনতা।
লেখক, মোঃ সোহেল রানা সফ্টওয়্যার ডেভেলপার, জাপানিজ ব্যাঙ্কে কর্মরত। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের লং আইল্যান্ডে বসবাস করছেন।




