গুম সনদে বাংলাদেশের স্বাক্ষর
উম্মে তাসবিহ
বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্ধকারতম অধ্যায়টির নাম গুম-খুনের রাজনীতি। সেখানে শুধু একজন মানুষ নিখোঁজ হওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়; ছিন্নভিন্ন একেকটি পরিবার, বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকা প্রিয়জন আর এক অনন্ত অনিশ্চয়তার যন্ত্রণা। এই মানবাধিকারবিরোধী অপরাধগুলো বহুদিন ধরেই জাতিসংঘের নজরে ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো—জাতিসংঘের কমিটি অন এনফোর্সড ডিজএপিয়ারেন্স (সিইডি) বা ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজএপিয়ারেন্সেস (ডব্লিউজিইআইডি) কেন এতদিন বাংলাদেশে আসতে পারেনি?
এর উত্তর লুকিয়ে আছে দুই স্তরে: আইনি বাধা এবং রাজনৈতিক অনীহা।
জাতিসংঘের “ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্যা প্রটেকশন অফ অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিজএপিয়ারেন্স’’ —সংক্ষেপে ‘সিইডি কনভেনশন’ —এ যোগ না দেওয়া পর্যন্ত কোনো দেশ জাতিসংঘের গুমবিরোধী কমিটির আনুষ্ঠানিক তদারকির আওতায় পড়ে না।
বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় এই সনদে স্বাক্ষর করেনি। ফলে জাতিসংঘের কমিটি চাইলেও এখানকার অভিযোগগুলো নিয়ে স্বাধীনভাবে অনুসন্ধান চালাতে বা সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে পারেনি।
এটি বদলায় ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট, যখন বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ওই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে। সেটিই ছিল একটি ঐতিহাসিক মোড়। এত বছর ধরে যেটি এড়িয়ে চলা হচ্ছিল, সেই স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দায় এখন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের আওতায় আসে।
২০১০–২০২৩ পর্যন্ত সময়ে মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমে বহুবার অভিযোগ উঠেছে যে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার গুমের ঘটনাগুলো ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করেছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে যখনই জাতিসংঘের সহায়তা চাওয়া হয়েছে, বিগত অনির্বাচিত সরকারের অবস্থান ছিল “দেশে এমন কিছু ঘটে না।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বারবার আওয়ামী সরকারের কাছে তথ্য চেয়েছে, কিন্তু কোনো পূর্ণাঙ্গ জবাব আসেনি। এই মনোভাবই মূলত জাতিসংঘের বিশেষ কমিটিগুলোর প্রবেশে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, কোনো দেশ চাইলে তবেই এমন ভিজিট ‘ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন’ হিসেবে সম্ভব হয়।
আওয়ামী সরকারের সময় গুম বা জোরপূর্বক নিখোঁজের ঘটনা অনেক পরিবার ও অধিকারকর্মীর কাছে দীর্ঘ দশকের দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের অনুসন্ধান, তথ্যাবলম্বন বা দোষীদের সনাক্তকরণ এসবে যে প্রক্রিয়া প্রয়োজন ছিল, তাতে অনেক বাধা ও অসহযোগিতা ছিল।
আওয়ামী সরকার প্রাথমিকভাবে গুমের স্বীকৃতি দিতে চাইত না বা নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের আইনগতভাবে মিসিং বা বিচারবহির্ভূত খুন-হিসেবেই দেখেছে। তার ওপর জাতিসংঘ বা স্বাধীন তদারকী সংস্থার সহায়তা গ্রহণ করতে রাজি হয়নি।
তথ্য সংগ্রহ, রেকর্ড সংরক্ষণ বা তদন্ত-প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ছিল না। সংগঠন ও পরিবারগুলোকে নানারকম হয়রানি করা হয়েছে। ফলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ছিল। এতে তাদের মানসিক আঘাত দীর্ঘায়িত হয়, সামাজিক নিরাপত্তা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়।
এইসব কারণ মিলিয়ে দেখা যায় বিগত আওয়ামী সরকারের সময় অনুসন্ধান ও জবাবদিহিতার সুযোগ যথেষ্ট ছিল না, আর সেটিই গুম-বিষয়ক সংকটকে আরও প্রকট করে তুলেছিল। অর্থাৎ, বাংলাদেশ ২০২৪ সালের আগে বিচারের দ্বার খুলতেই দেয়নি।
২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। উদ্যোগগুলো গুম-খুনে বিপর্যস্ত ব্যক্তি ও পরিবারগুলোর প্রত্যাশা পূরণ না হলেও একটি দৃশ্যমাণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার:
১. আগস্ট ২০২৪-এ একটি নিরীক্ষণ কমিশন গঠন করা হয় গুম ও জোরপূর্বক নিখোঁজের বিষয়ে।
২. গুম প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আইন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, “এনফোর্সড ডিজঅপিয়ারেন্স (গুম)-বিষয়ক আইন এক মাসের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে”।
৩. পুলিশ প্রশাসন ও বিচারের ক্ষেত্রেও কিছু মামলা উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত গণহত্যাসহ গুম ও বিচারহীনতার বিষয় নিয়ে তদন্তকারীদের অগ্রগতি রয়েছে।
তবে এই উদ্যোগগুলো বিভিন্ন ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলসমূহের চাপের মুখে পড়ে গুরুত্ব হারাচ্ছে দিন দিন। অনেক মামলায় অভিযুক্তরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে, অনেক অনুসন্ধান স্থবির রয়েছে।
সনদে স্বাক্ষরের এক বছর পর, অবশেষে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দল। ২০২৫ সালের ১৫ থেকে ১৮ জুন, জাতিসংঘের Working Group on Enforced or Involuntary Disappearances (WGEID)-এর একটি টেকনিক্যাল প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসে। দলে ছিলেন উপ-চেয়ার গ্রাজিনা বারানোস্কা এবং সদস্য আনা লোরেনা ডেলগাদিলো পেরেজ।
এটি কোনো পূর্ণাঙ্গ তদন্ত নয়, বরং একধরনের “টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি ভিজিট”—যেখানে দলটি সরকারের সঙ্গে, মানবাধিকার কমিশন ও ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে। তারা গুমবিরোধী কমিশনের কাঠামো, তথ্য সংরক্ষণ, সাক্ষ্য যাচাই এবং ভবিষ্যৎ তদন্ত প্রক্রিয়া কিভাবে হতে পারে সে বিষয়ে প্রাথমিক সুপারিশ তৈরি করে।
ওই চার দিনের সফর হয়তো আকারে ছোট ছিল, কিন্তু তা ছিল বাংলাদেশের মানবাধিকার ইতিহাসে এক বড় পদক্ষেপ। কারণ, এর মাধ্যমেই প্রথমবার জাতিসংঘের একটি আনুষ্ঠানিক টিম স্বীকৃতভাবে গুমের মতো স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে মাঠে কাজ করে। তবে, শুধু সনদে স্বাক্ষরই যথেষ্ট নয়। কার্যকর তদন্তের জন্য সরকারকে এখন বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।গুম সংক্রান্ত সব মামলা স্বাধীন তদন্ত কমিশনের আওতায় আনা, নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের সাক্ষ্য সুরক্ষিত রাখা ও নিরাপত্তা বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করা।
গুমের মতো বিষয় কেবল ব্যক্তিগত নয়, এটি রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কের পরীক্ষা। বাংলাদেশের উচিত হবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেওয়া অঙ্গীকারগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। কারণ, যতক্ষণ পর্যন্ত একজন নাগরিকও নিখোঁজ থাকেন, ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের মানবিক মর্যাদাও অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন—যদি রাষ্ট্র আবার পুরনো নীরবতায় ফিরে যায়, তাহলে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের এই সফর হবে আরেকটি সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারের পরিকল্পনাকে পথ করে দেয়া এবং সদ্য স্বাক্ষরিত এই সনদও হবে সরকারি ফাইলবন্দী নথিস্তুপের নতুন আরেকটি সংযোজন।
তথ্যসূত্র:
১. জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় (OHCHR) – “বাংলাদেশ সফর সংক্রান্ত কার্যদল (Working Group on Enforced or Involuntary Disappearances - WGEID)-এর কারিগরি সফর বিষয়ে প্রেস বিবৃতি”, জুন ২০২৫।
২. অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল – “বাংলাদেশ জাতিসংঘের গুমবিরোধী সনদে স্বাক্ষর করল”, ২৯ আগস্ট ২০২৪।
৩. হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) – “বাংলাদেশ: গুম, অপহরণ ও দায়মুক্তি”, বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮–২০২৪।
৪. প্রথম আলো – “গুম নিয়ে আলোচনা করতে জাতিসংঘ প্রতিনিধি দল ঢাকায়”, ১৬ জুন ২০২৫।
৫. দ্য ডেইলি স্টার – “অবশেষে জাতিসংঘের গুমবিরোধী সনদে যোগ দিল বাংলাদেশ”, ৩০ আগস্ট ২০২৪।



