বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ড: দুর্ঘটনা না কি পরিকল্পিত যড়যন্ত্র?
মোহাম্মদ আবেদ আবদুল্লাহ
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। ঢাকার মিরপুর এলাকার গার্মেন্টস কারখানা ও রাসায়নিক গোডাউনে ভয়াবহ আগুন, এরপর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে বিশাল অগ্নিকাণ্ড—এই ধারাবাহিক ঘটনাগুলো জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বড় আগুন লাগার কারণে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, “এগুলো কি শুধুই দুর্ঘটনা, নাকি কোনো পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র?”
একই সময়ে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আগুন লাগা কাকতালীয় বলে মনে করা কঠিন। এক সপ্তাহের মধ্যে গার্মেন্টস কারখানা, রাসায়নিক গোডাউন ও বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লেগেছে। প্রতিটি স্থানই দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই সুসংগত ধারাবাহিকতা থেকেই জনমনে সন্দেহ জন্মাচ্ছে যে ঘটনাগুলো হয়তো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
এই আগুনগুলোর ফলে দেশের রপ্তানি খাত, লজিস্টিক সাপ্লাই চেইন এবং বিনিয়োগ পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রপ্তানির পোশাক, কাঁচামাল ও কার্গো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) পর্যন্ত জানিয়েছে—“এই অগ্নিকাণ্ডগুলো পরিকল্পিতও হতে পারে।” এমনকি “পড়শি দেশের স্বার্থ জড়িত থাকতে পারে”—এমন ইঙ্গিতও দিয়েছে তারা।
বর্তমানে দেশে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল সময় চলছে। বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠী সরকারের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন নিয়ে ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বড় বড় আগুনের পুনরাবৃত্তি অনেকের কাছে “অস্থিরতা সৃষ্টির কৌশল” বলেই মনে হচ্ছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ, উভয় দলই কোনো না কোনোভাবে “ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত” দিয়েছেন।
যড়যন্ত্রের সন্দেহের পাশাপাশি বাস্তবিক কিছু কারণও রয়েছে, যেগুলো উপেক্ষা করা যায় না। অনেক কারখানা ও ভবনে এখনো পুরনো বৈদ্যুতিক সংযোগ, অকার্যকর ফায়ার সিস্টেম এবং নিরাপত্তা নির্দেশনা লঙ্ঘন রয়ে গেছে। অনেক ভবনে জরুরি নির্গমন পথ বন্ধ থাকে, যার ফলে সামান্য আগুনও বড় বিপর্যয়ে রূপ নেয়। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৭০টিরও বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে বোঝা যায়, নিরাপত্তাহীন অবকাঠামোই বড় ঝুঁকির মূল কারণ হতে পারে।
১৪ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে মিরপুরের গার্মেন্টস কারখানা ও রাসায়নিক গোডাউনে ভয়াবহ আগুন লাগে। আগুন প্রথমে কারখানায়, পরে পাশের রাসায়নিক গোডাউনে ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, প্লাস্টিক ও ব্লিচিং পাউডার সংরক্ষিত ছিল। অন্তত ১৬ জন নিহত ও বহু আহত হয়। প্রতিবেদনে জানা গেছে, ভবনের ছাদের দরজা লক করা ছিল। ফলে অনেক শ্রমিক বের হতে পারেননি। তদন্তে দেখা যাচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল এবং অনুমোদন সঠিকভাবে নেওয়া হয়নি।
১৮ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ আগুন লাগে। এতে বহু রপ্তানিযোগ্য মালামাল পুড়ে যায়। কয়েক ঘণ্টা বিমানবন্দরের অপারেশন বন্ধ থাকে, ফলে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ও বাণিজ্যে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। প্রাথমিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি বলে অনুমান করা হচ্ছে। আগুনের কারণ এখনও নির্ধারিত হয়নি, তবে নিরাপত্তা ঘাটতি ও রাসায়নিক সংরক্ষণের নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয় তদন্তে রয়েছে।
এই ঘটনাগুলোর সম্ভাব্য উদ্দেশ্য নিয়েও নানা বিশ্লেষণ চলছে। কেউ কেউ মনে করছেন, অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা থেকে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হতে পারে। রপ্তানিতে ধাক্কা লাগলে বিদেশি ক্রেতারা বিকল্প বাজারে চলে যেতে পারেন। আবার কারও মতে, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে আন্তর্জাতিক মহলে “বাংলাদেশ নিরাপদ বাণিজ্য কেন্দ্র নয়”—এমন ধারণা তৈরি করার প্রচেষ্টা থাকতে পারে। অন্যদিকে কেউ কেউ বলছেন, জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও অসন্তোষ ছড়িয়ে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরিই হয়তো উদ্দেশ্য।
এই পরিস্থিতিতে জনগণের সরকার ও প্রশাসনের ওপর বিশ্বাস কমে যেতে পারে। রপ্তানি বিলম্ব, বিমা খরচ বৃদ্ধি, এবং বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। নিরাপত্তা কাঠামো দুর্বল থাকলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় ঘটার আশঙ্কাও রয়ে গেছে।
এখন সবচেয়ে জরুরি হলো দ্রুত ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করা, যাতে আগুনের প্রকৃত কারণ ও দায়ী ব্যক্তি বা সংস্থা চিহ্নিত হয়। কারখানা ও গোডাউনে নিরাপত্তা মানদণ্ড বাধ্যতামূলক করা, নিয়মিত ফায়ার ড্রিল, নিরাপত্তা পরিদর্শন এবং অনুমোদন যাচাই করা প্রয়োজন। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে রিস্ক ম্যানেজমেন্ট গড়ে তোলা, শিল্প, বিমানবন্দর ও কার্গো হাবে বহুস্তরীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করা দরকার। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাও গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অগ্নি-নিরাপত্তা বিষয়ে প্রচার জোরদার করা জরুরি।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয় বরং এগুলো দেশের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যড়যন্ত্রের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে প্রমাণ ছাড়া নিশ্চিত সিদ্ধান্তেও পৌঁছানো ঠিক নয়।
সবচেয়ে জরুরি এখন, তদন্তে সত্য উদঘাটন, নিরাপত্তা সংস্কার, এবং জনগণের মধ্যে স্বচ্ছ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করা। কারণ, যদি এটি দুর্ঘটনা হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ রক্ষায় প্রতিকার দরকার; আর যদি এটি যড়যন্ত্র হয়, তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষায় তা চিহ্নিত করা অপরিহার্য।



