মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভারের দুর্ঘটনা আমাদের কী শেখায়?
মোহাম্মদ জাকির হোসাইন
উন্নয়নের নামে মৃত্যুফাঁদ
ঢাকার মেট্রোরেলে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে ২৫ অক্টোবর দুপুরে, যখন ফার্মগেট স্টেশনের উপরের ভায়াডাক্ট থেকে একটি বেয়ারিং প্যাড পড়ে একজন পথচারীকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে এবং আরও দুজনকে আহত করে। এটি প্রথম এমন ঘটনা নয়। এর আগে, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে একই এলাকার কাছাকাছি আরেকটি মেট্রোরেল ভায়াডাক্ট থেকে একটি বেয়ারিং প্যাড পড়ে, যার ফলে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল প্রায় ১১ ঘণ্টার জন্য বন্ধ থাকে। যদিও সেই দুর্ঘটনায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি, তবুও বিশেষজ্ঞরা সম্ভাব্য নকশাগত ত্রুটি সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন এবং তাৎক্ষণিক সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
আমাদের দেশে প্রায়ই কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু সেই কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় না, আর তাদের সুপারিশও বাস্তবায়ন করা হয় না। জনগণের করের টাকায় নির্মিত ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল আজ যেন উন্নয়নের প্রতীক নয়, বরং একেকটি মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। একজন মানুষের জীবন কি মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকার সমান? সরকারের উচিত দেশের সব ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলের নিরাপত্তা পর্যালোচনা করা এবং দায়িত্বহীন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া—যাতে আর কোনো নিরীহ প্রাণ অকারণে ঝরে না যায়।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর বহদ্দারহাটের কেন্দ্রে “বিগ সিটি ক্লক” থেকে প্রায় ২০ মিটার দূরে ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে। ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ১১ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হন। তেমনি, ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট উত্তরার বিআরটি (BRT) প্রকল্পের একটি গার্ডার একটি চলন্ত গাড়ির ওপর পড়ে একই পরিবারের পাঁচজন সদস্য ঘটনাস্থলেই নিহত হন।
এই ঘটনাগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—উন্নয়ন কেবল অবকাঠামোর প্রসার নয়, বরং নিরাপত্তা, জবাবদিহিতা ও মানুষের জীবনের মর্যাদা নিশ্চিত করাই এর আসল অর্থ।
দায়ীদের শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের দাবি
সরকারের উচিত এই দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রকৌশলী, তদারক কর্মকর্তা ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া। কেবল প্রশাসনিক বদলি বা সতর্কবার্তা নয়—অবহেলার কারণে মৃত্যুর দায়ে ফৌজদারি মামলা হওয়া উচিত।
একজন পথচারীর জীবন কোনো প্রকল্পের ভুল হিসাবের চেয়ে কম মূল্যবান হতে পারে না। নিহতের পরিবারকে ন্যায্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে অন্তত ৫০ লক্ষ টাকা প্রদান করা উচিত, যা শুধু অর্থনৈতিক সান্ত্বনা নয়, বরং রাষ্ট্রের দায় স্বীকারের প্রতীক হবে। একই সঙ্গে আহতদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের দায়িত্বও প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।
মানুষের প্রাণের বিনিময়ে উন্নয়নকে কখনোই “সফলতা” বলা যায় না। সময় এসেছে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে নিরাপত্তা নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা, দোষীদের জবাবদিহির আওতায় আনা, এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা—যাতে উন্নয়ন প্রকৃত অর্থে মানবিক হয়, কাগজের নয়।




