রাজনীতিবিদ ও নাগরিকের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে জরুরী প্রশ্ন
মোঃ সোহেল রানা
সামাজিক মাধ্যমে সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিও আবারও আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অস্বস্তিকর বাস্তবতাকে সামনে এনেছে। ভিডিওতে দেখা যায়—একজন সাধারণ কর্মী একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হওয়ার পর জিজ্ঞেস করছেন, “আমাকে চিনছেন নি?” এর ঠিক পরেই নেতার বিরক্তি, অস্বস্তি এবং ধাক্কার মতো আচরণ জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বিষয়টি নিয়ে সারা দেশেই আলোচনা চলছে। সবার মনে একই প্রশ্ন—এই আচরণ কি আমরা বছরের পর বছর ধরে যেটা দেখছি, সেই একই পুরনো রাজনৈতিক মানসিকতার প্রতিচ্ছবি নয়?
কোন আইনে আছে যে রাজনীতিবিদ চাইলে সাধারণ নাগরিকের গায়ে হাত তুলতে পারেন?
স্পষ্ট উত্তর—কোনো আইনে নেই।
আইনের দৃষ্টিতে কেউ কারো ওপর শারীরিক আঘাত করতে পারেন না। নাগরিকের মর্যাদা সবার সমান। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা হলো, অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের এমন আচরণ দীর্ঘদিন ধরেই “স্বাভাবিক” হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ক্ষমতার কাছে সাধারণ মানুষের মর্যাদা বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, এবং রাজনীতিবিদ হলে সেটি আরও “গ্রহণযোগ্য” হয়ে ওঠে। এই মনোভাবই আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক দুর্বলতার মূল চাবিকাঠি ছিল এবং বর্তমানেও তা অব্যাহত রয়েছে।
এই ঘটনাটি মনে করিয়ে দেয়—রাজনীতিবিদ ও জনগণের সম্পর্কটি যতটা দৃশ্যমান, তার চেয়ে অনেক বেশি ভঙ্গুর। এবং সত্য বলতে, সেই সম্পর্কটি খুব দীর্ঘস্থায়ীও নয়। অনেক ক্ষেত্রেই টিকে থাকে শুধু ভোটের দিন পর্যন্ত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর কতদিন?
আমরা কি চাইলে এই চর্চার পরিবর্তন আনতে পারি না?
রাজনীতি কি ক্ষমতার জোরের পরিবর্তে মেধা, নৈতিকতা ও যোগ্যতার প্রতিযোগিতা হতে পারে না?
সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের সম্পর্ক ভয় কিংবা লাঞ্ছনার বদলে, সম্মান ও আস্থার ভিত্তিতে দাঁড়াতে পারে না?
সবই সম্ভব। তবে পরিবর্তনের শুরুটা করতে হবে নাগরিক সমাজ থেকেই। আপনি-আমি যে প্রশ্ন তুলতে পারি, সমালোচনা করতে পারি—একজন অতি সাধারণ মানুষ তা করতে পারেন না তার সামাজিক অবস্থানের কারণে। বরং বরাবরই তারা ক্ষমতাধরদের হাতে লাঞ্ছনার শিকার হন, এবং সেই লাঞ্ছনা দীর্ঘদিন ধরে নীরবে সয়ে যান।
আজকের বাংলাদেশে এক ধরনের শিক্ষিত শ্রেণি তৈরি হয়েছে—যারা শিক্ষায় দক্ষ কিন্তু মননে অপূর্ণ।
তারা মুখে দেশপ্রেম দেখান, কিন্তু বাস্তবে সুযোগ পেলে দেশকে অবজ্ঞা করেন।
তাদের চিরাচরিত যুক্তি—দেশের অবস্থা ভালো না, রাজনীতিবিদেরা খারাপ।
কিন্তু আমার প্রশ্ন তাদের প্রতি—
আপনি কি আপনার অবস্থান থেকে ন্যূনতম প্রতিবাদটুকু করেছেন?
পরিবর্তনের জন্য কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন?
যা প্রমাণ করে যে আপনি সত্যিই দেশকে ভালোবাসেন?
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, পেশাগত জীবনে সফল হওয়া মানুষদের দায়িত্ব এখানে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ যখন নিম্নমানের জীবনে আটকে আছে, তখন ১০ শতাংশ এলিট শ্রেণি উপভোগ করেন বিলাসী জীবন। এদের অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশের বাইরে বাস করেন। ফলে দেশের প্রকৃত পরিবর্তনে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
সামনে নির্বাচন।
প্রতিবারের মতো এই নির্বাচনেও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্ক শুরু হবে ভোটের দিন, আর শেষও হবে ভোটের দিনই। ভোটের পরে আবারও তারা হয়ে যাবেন উপেক্ষিত, গুরুত্বহীন, ক্ষমতার দূরত্বে ঠেলে রাখা প্রজার মতো।
কিন্তু আমরা চাইলেই এই রাজনৈতিক কালচারের পরিবর্তন করতে পারি—ওই একটি ভোটের ক্ষমতাই প্রয়োগের মাধ্যমে।
এখনই সময় কথিত এলিট শ্রেণীকে দূরে ঠেলে দিয়ে প্রকৃত নেতৃত্ব বাছাইয়ের। যা আপনি করতে পারেন আপনার ওই একটি অমূল্য ভোটের মাধ্যমে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান মানুষকে দেখিয়েছিল অন্যরকম এক সম্ভাবনা—এক নতুন বাংলাদেশ, যা হবে পরিবর্তনের, ন্যায়ের, নতুন নেতৃত্বের। যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান আচরণে অনেকেই হতাশ, কিন্তু এই হতাশার মধ্যেই গণঅভ্যুত্থানের তরুণ নেতৃত্ব গঠন করেছে নতুন দল।
নতুন প্রজন্মের এই উদ্যোগ রাজনৈতিক ক্ষেত্রকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। তারা বলছে—
“রাজনীতি হবে সাধারণ মানুষের জন্য।”
“ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ নয়, নাগরিক অধিকারই হবে মূল বিষয়।”
“রাজনীতি হবে উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম—এটি হবে না এলিট শ্রেণীর ক্লাব।”
“পরিবর্তন আসবে তরুণদের প্রাণশক্তি ও নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।”
যারা ২০২৪-এর গণআন্দোলনের স্পিরিট ধারণ করছে—দুর্নীতির বিরুদ্ধে, ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে, এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রত্যাশা তৈরি করছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও তাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছে এবং তরুণদের সফলতার জন্য অপেক্ষা করছে।
২০২৬ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য শুধু আরেকটি নির্বাচন নয়—এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ টিপিং পয়েন্ট।
এখানে ঠিক হবে—আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই?
ক্ষমতার জুলুমের বাংলাদেশ?
নাকি সম্মানের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নাগরিক রাষ্ট্র?
তাই ভোট শুধু একটি ভোট নয়—এটি একটি আমানত। যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আপনার, আপনার সন্তানের এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনের পথ।
সবশেষে বলতে চাই—বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তির রাজনীতি নয়, সম্মানের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা হোক।
নেতা ও জনগণের সম্পর্ক হোক দায়িত্ব, মর্যাদা ও আস্থার।
রাজা-প্রজার মানসিকতা নয়—নাগরিক-রাষ্ট্র সম্পর্কই হোক নতুন পথের ভিত্তি।



