ঘোষিত জুলাই প্রক্লেমেশন নিজেই জুলাই গণঅভ্যুত্থান বিরোধী
যোবায়ের আল মাহমুদ, সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মাকোলজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জুলাই প্রক্লেমেশন ( ঘোষণাপত্র) প্রনয়নকারীদের আইন/সংবিধান এবং গণক্ষমতার আন্তঃসম্পর্ক সম্পর্কে যে পরিষ্কার কোন ধারনা নাই তাই প্রমানিত হল। গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকারের বৈধতার জন্য চলমান সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের কাছে যে আশ্রয় নেয়া হল এবং তার ফলে যে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কাছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী সম্ভাবনা ( রাষ্ট্র কাঠামোর বৈপ্লবিক এবং মৌলিক পরিবর্তন) বলি দেয়া হয়েছে তা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট বিরোধী।
যে কোন গণঅভ্যুত্থান/গণবিপ্লব নিজেই নিজের বৈধতা। গণঅভ্যুত্থান নিজেই জনতার সার্বভৌম অভিপ্রায়ের সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশ বলে তার বৈধতা বিদ্যমান আইন বা সংবিধান এর অধীন নয়, বরং গণঅভ্যুত্থান নিজেই নিজেকে বৈধ করে। ফলে জুলাই প্রক্লেমেশনে যে গণঅভ্যুত্থানের সরকারের বৈধতার জন্য চলমান সংবিধানের কাছে আশ্রয় নেয়া হইছে এটা চরম রাজনৈতিক ভুল।
কেননা এই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে বিদ্যমান সংবিধানের ক্ষমতা বলয় এবং ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধেই, ফলে সেই ফ্যাশিস্ট সংবিধানের কাছেই বৈধতা চাওয়া নিজেই গণঅভ্যুত্থান বিরোধী। এর ফলে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে গণক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে তাকে নতুন রাষ্ট্র গঠনের কাজে না লাগিয়ে এই গাঠনিক শক্তিকে আবারো পুরানা সংবিধানের কাঠামোর মাঝে বিলীন করে দেয়া হয়েছে।
কেননা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার মানে হচ্ছে এই সংবিধান যেই 'সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের' জন্ম দিয়েছে, যেই নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক কাঠামো বলবত করেছে তাকেই বহাল রাখা। আবার সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা মানে একই সাথে বলপ্রয়োগভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো এবং রিপ্রেসিভ আইন, উপনিবেশিক আইন সব অব্যাহত থাকা।
২. ইউনূস সরকারের রাজনৈতিক থিংক ট্যাংকরা যে আধুনিক স্টেট কাঠামোতে ক্ষমতা, ভায়োলেন্স এবং আইন/সংবিধানের আন্তঃসম্পর্ক বুঝতে অক্ষম তার প্রমান হচ্ছে তারা গণঅভ্যুত্থান, গণঅভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকার এবং সরকারের কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কারের বৈধতার জন্য চলমান সংবিধানের কাছে এবং পরবর্তী নির্বাচিত সংসদের কাছে আশ্রয় নিয়েছেন। আধুনিক স্টেট কাঠামোতে ক্ষমতাই আইন এবং সংবিধানের উৎস এবং আইন মাত্রই বলপ্রয়োগ করে প্রয়োগ করতে হয় বলে আইনের বেসিস হচ্ছে ভায়োলেন্স। লিগাল সিস্টেমের ইনহেরেন্ট ' ভায়োলেন্স' প্রয়োগ করাকে রাষ্ট্রের নাগরিকরা লেজিটিমেইট বলে মেনে নেয় কেননা এতে করে রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা বিধান করবে এবং সমাজে- রাষ্ট্রে একটা শান্তি, শৃঙ্খলা রক্ষা করা হবে।
কিন্তু যদি সেই আইন জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করতে না পারে উল্টা চরম নির্যাতন নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠে তখন পিপল গণ-আন্দোলন/গণ-অভ্যুত্থান/ রিভ্লুশন করে বিদ্যমান কাঠামো উচ্ছেদ করে যা পুরানা সংবিধান/আইন অনুযায়ী বে-আইনী হলেও জনগনের জাস্টিস প্রতিষ্ঠার যে নৈতিক, মানবিক, আত্মিক এবং রাজনৈতিক আকংখা তার বেসিসে তা ন্যায়সঙ্গত। অর্থাৎ গনঅভ্যুত্থান বিদ্যমান আইনের বাইরের ব্যাপার এবং গণঅভ্যুত্থান নিজেই নতুন আইন তৈরির বৈধতা দেয়।
পুরানা সিস্টেমের আইন/সংবিধানের আশ্রয় নিয়ে স্টেট যখন জনতার উপর ভায়োলেন্স করে তখন তার বিরুদ্ধে জনগন গণঅভ্যুত্থান করে পাল্টা রিভলিউশনারি ভায়োলেন্সের মাধ্যমে যাকে জার্মান দার্শনিক বেঞ্জামিন বলেছেন ডিভাইন ভায়োলেন্স।
আবার কোন কোন রাজনৈতিক ফিলোসোফার একে বলেন ইমান্সিপেটরি ভায়োলেন্স। পুরানা কাঠামোর পক্ষে সম্মতি উৎপাদনকারিরা একে বলে 'দাঙ্গা', " সন্ত্রাস" " জঙ্গিবাদ" ( যেমন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নির্বিচার গণহত্যা এবং স্টেট ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা আত্ম-রক্ষার্থে যে রিভলুশনারি ভায়োলেন্স করেছে তাকে ফ্যাসিবাদী বুদ্ধিজীবীরা প্রথম থেকেই 'সন্ত্রাসি কাজ', 'ধ্বংসাত্মক কাজ', 'জঙ্গিবাদিতা', 'দাঙ্গা' বলে ট্যাগসন্ত্রাস করেছে)।
জনগন পুরানা অন্যায্য সিস্টেম/কাঠামোকে উচ্ছেদের জন্য এই যে রিভ্লুশনারি ভায়োলেন্স প্রয়োগ করে তার লক্ষ্য হচ্ছে ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং জুলুমের ন্যায়বিচার এবং তার জন্য প্রথম দরকার হচ্ছে পুরানা জুলুমতন্ত্রের আইন/সংবিধানকে উচ্ছেদ করে নতুন আইন/সংবিধান প্রণয়ন করা। অর্থাৎ গণঅভ্যুত্থানের যে রিভ্লুশনারি পটেনশিয়াল তাকে ট্র্যান্সলেট করতে হয় নতুন ক্ষমতা-কাঠামো তৈরি করে যা নতুন আইন/সংবিধান প্রণয়ন করবে। অর্থাৎ রিভ্লুশনারি ভায়োলেন্স এর ট্রান্সফর্মেটিভ পাওয়ার থাকতে হবে।
৩) এখন জুলাই গণঅভ্যুত্থান কেন হইছে? কারন বিদ্যমান আইন/সংবিধান/ রাজনৈতিক সিস্টেম জনগনকে নির্যাতন নিপীড়নের টুল হিসেবে ইউজ করেছে ফ্যাসিবাদী রেজিম। উপনিবেশিক পুলিশ আইন ( ১৮৬১, ১৮৮৯), উপনিবেশিক আমলাতন্ত্র, উপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্র, ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন, রেব আইন ২০০৩, সন্ত্রাস বিরোধী আইন ২০০৮, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ২০১৮ থেকে শুরু করে নানা দমনমূলক আইনের ভিত্তিতে জনগনকে গুম-খুন-ক্রসফায়ার করে একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করাতে এবং চলমান সংবিধানের ক্ষমতা-কাঠামো এবং ভাবাদর্শের মাঝে উপনিবেশিক-ফ্যাসিস্ট-মাফিয়া সিস্টেমের জুলুমতন্ত্র প্রোথিত থাকায় একটা সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ কায়েম হইছে যা স্টেট ভায়োলেন্সের ন্যায্যতা দিয়েছে।
এই ফ্যাসিস্ট ভায়োলেন্সের ( যাকে ওয়াল্টার বেঞ্জামিন বলেন মিথিক ভায়োলেন্স) বহিঃপ্রকাশ ছিল নজরদারি, গুম-খুন-ক্রসফায়ার-আয়নাঘর নির্যাতন, কয়েকটা ম্যাসাকার।এই স্টেট ভায়োলেন্সের সবচেয়ে ভয়ানক প্রকাশ ঘটে জুলাই গণহত্যার মাধ্যমে যার ফলে এদেশের ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থান করে এই রেজিমের পতন ঘটায়। ফলে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে উত্থিত গণ-ক্ষমতার যে রিভ্লুশনারি পটেনশিয়াল তাকে ট্র্যান্সলেট করতে হত নতুন সংবিধান/নতুন আইনে।উপনিবেশিক-ফ্যাসিস্ট-মাফিয়া সিস্টেমের জুলুমতন্ত্র যে সংবিধানের ক্ষমতা-কাঠামোতে প্রোথিত তাকে উচ্ছেদ করাই হচ্ছে গণঅভ্যুত্থানের প্রথম দাবি এবং আকাঙ্ক্ষা কেননা এসব অক্ষত রেখে জাস্টিস প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
ওয়াল্টার বেঞ্জামিন এর মতে এই ট্র্যান্সফর্মেটিভ রিভ্লুশনারি ভায়োলেন্স/ গণ-আন্দোলনের কাজ হচ্ছে পুরানা অন্যায্য সব আইন, লিগাল ভায়োলেন্স এবং স্টেট ভেঙ্গে দেয়া আর নতুন ইতিহাস তৈরি করা। অথচ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এই রিভ্লুশনারি পটেনশিয়ালকে নস্যাৎ করে দেয়া হইছে পুরানা সংবিধানের মাঝে অর্থাৎ পুরানা সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তাকে রক্ষার জন্য তার কাছেই শপথ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে। এটা রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিকভাবে একটা চরম অন্যায়।
জুলাই হইছে পতিত রেজিমের সাংবিধানিক কাঠামোর লিগাল সিস্টেমকে নাকচ করেই, ফলে জুলাই ঘোষণা-পত্র পুরানা আইন/পুরানা সংবিধানের অন্যায্যতা তুলে ধরে তাকে নাকচ করে নতুন গণ-ক্ষমতার ভিত্তিতে নতুন গণতান্ত্রিক আইন/ সংবিধান প্রণয়ন এর ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশের পুরানা রাজনীতিবিদরা এটা বুঝতেই পারছেন না যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে গণ-ক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে তার ভিত্তিতে উপনিবেশিক-ফ্যাসিস্ট-মাফিয়া সিস্টেমের রক্ষাকবচ আইনগুলা বাতিল/ব্যাপক সংস্কার করে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান/ গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের দিকে যাত্রা করাই ছিল গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রধান রাজনৈতিক কাজ। জুলাই ঘোষণাপত্রের প্রধান ঘোষণাই হওয়া দরকার ছিল নির্বাচিত গণপরিষদ/গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র/সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণা দেয়া। অথচ জুলাই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে:
“বর্তমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে” ( দফা ২২)। “সুশাসন ও সুষ্ঠু নির্বাচন ... নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে বিদ্যমান সংবিধান ও সকল রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গণতান্ত্রিক সংস্কার সাধনের অভিপ্রায়” ( দফা ২৫)। ফলে গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন রাষ্ট্র গড়ার জন্য নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করে রাষ্ট্রকাঠামোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার যে গণদাবি ছিল তাকে দায়সারা সংস্কার এর ঘোষণা দিয়ে ঠেকিয়ে দেয়ার কৌশল নেয়া হয়েছে।
৪) জুলাই ঘোষণাপত্রে যেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হয়েছে তার বৈধতাও চাওয়া হয়েছে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সংসদের কাছে, ফলে এই প্রক্লেমশনের নিজেরই বৈধতা নির্ভর করছে পরবর্তী সরকারের উপর। দুনিয়া জুড়েই যে কোন গণঅভ্যুত্থানের বা গণবিপ্লবের প্রক্লেমেশন নিজেই নিজেকে বলবৎ করে,চলমান সংবিধান বা পরবর্তী সরকারের কাছে বৈধতা খোঁজার মানে হচ্ছে এই প্রক্লেমেশন গণঅভ্যুত্থানে উত্থিত গণক্ষমতাকে অস্বীকার করছে।